আইএস তাণ্ডব
জ্ঞানের ভাণ্ডার রক্ষা করেছিলেন তিনি
গ্রন্থাগার জ্ঞানের ভাণ্ডার। একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায় তার ইতিহাস, সাহিত্য আর রাজনীতির বইয়ে। এই ভাণ্ডার ধ্বংস করতে পারলে একটি জাতিকে দিকশূন্য ও পঙ্গু করে দেওয়া সম্ভব। আর তাই পৃথিবীতে সবসময় যেকোনো যুদ্ধে বা সংঘাতের সময় চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিপক্ষের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে তাকে সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার। আফ্রিকায় জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে জঙ্গিদের কবল থেকে একটি পাঠাগারের দুর্লভ বই, পাণ্ডুলিপি রক্ষা করেছিলেন মধ্যবয়সী একজন বই সংগ্রাহক ও গ্রন্থাগারিক। তাঁর সেই সংগ্রামের কাহিনী উঠে এসেছে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাংবাদিক ও লেখক জশুয়া হ্যামার। সেই প্রতিবেদন ভাষান্তর করে প্রকাশ করা হলো।
এই কাহিনী নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন জশুয়া হ্যামারের লেখা বই ‘দ্য ব্যাড-অ্যাজ লাইব্রেরিয়ান্স অব তিমবুকতু : অ্যান্ড দেয়ার রেস টু সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড’স মোস্ট প্রেশিয়াস ম্যানুস্ক্রিপ্টস’।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় জঙ্গিদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তারা বহু প্রাচীন পাঠাগার পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে। ২০১৪ সালের শুরুতে আল কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা ইরাকের মসুল শহর দখল করে। এ সময় তারা পুরো এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ধ্বংস করে মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ অন্যান্য উপাসনালয়।
একইসঙ্গে তিকরিত থেকে ত্রিপোলি পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিশ্চিহ্ন করতে থাকে জঙ্গিরা। এরই অংশ হিসেবে সিরিয়ার প্রাচীন শহর পালমিরাতেও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। তবে তা আবারো সরকারি বাহিনী দখলে নেওয়ার পর শহরটির পুরোনো ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে এরকম ধ্বংসযজ্ঞের বিপরীতেও কোনো কোনো মানুষ একাই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক রক্ষা করেছেন অসীম সাহসিকতার সঙ্গে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির আবদেল কাদের হায়দারা তেমনই একজন মানুষ। ৫১ বছর বয়সী হায়দারা একজন বই সংগ্রাহক ও গ্রন্থাগারিক। মালির তিমবুকতু শহরের হাজার বছরের ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন তিনি।
এর শুরুটা আজ থেকে চার বছর আগে ২০১২ সালের এপ্রিলে। কাজের জন্য হায়দারা ছিলেন তিমবুকতুর বাইরে। শহরে ফিরতে ফিরতে তিনি শুনতে পান ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠী মালিয়ান সেনাবাহিনীকে হটিয়ে তার শহর দখল করে নিয়েছে। প্রায় এক হাজার জঙ্গি তখন তিমবুকতু দখল করে রেখেছে। শহরে ফিরে তিনি দেখেন শহরজুড়ে নৈরাজ্য চলছে, এলোপাতাড়ি গুলির আওয়াজ আর সব সরকারি ভবনে তোলা হয়েছে কালো পতাকা।
তিমবুকতুর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল হাজার বছরের পুরোনো আরবি পাণ্ডুলিপি, বই ও ইতিহাসের স্মারকগ্রন্থ। এ ছাড়া হায়দারার নিজস্ব পাঠাগার ‘মাম্মা হায়দারা কোম্মেমোরেটিভ লাইব্রেরি’তে ছিল দুর্লভ সব বইয়ের সংগ্রহ।
হায়দারার সংগ্রহে ছিল ১২০০ শতাব্দীর পুরোনো একটি কোরআন শরিফ। এই কোরআন শরিফ লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় মাছের শুকনো চামড়া। উজ্জ্বল নীল রং আর সোনালি রঙের কালি দিয়ে সেই কোরআনের হরফগুলো লেখা হয়েছিল।
জ্যোতির্বিদ্যা, কবিতা, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যার এ রকম আরো দুর্লভ পাণ্ডুলিপি ও বইয়ের সংগ্রহ ছিল হায়দারার কাছে। এর মধ্যে ছিল শল্যচিকিৎসার ওপরে ২৫৪ পাতার একটি ভলিউম। পাখি, টিকটিকি ও বিভিন্ন গাছগাছালি দিয়ে কীভাবে জটিল রোগের ওষুধ তৈরি করা যায় তার বর্ণনা ছিল ওই বইয়ে। ১৬৮৪ সালে তিমবুকতে বইটি লেখা হয়েছিল।
হায়দারার মনে আশঙ্কা ছিল জঙ্গিরা এসব দুর্লভ সংগ্রহ ধ্বংস করে ফেলতে পারে। যেহেতু তাদের মতাদর্শের সঙ্গে এসব বইয়ের বক্তব্য সাংঘর্ষিক। আর সেই আশঙ্কা থেকেই এসব বই বাঁচানোর পরিকল্পনা শুরু করেন হায়দারা।
জঙ্গিরা তিমবুকতু দখল করে নেওয়ার কিছুদিন পরই সহকর্মী গ্রন্থাগারিকদের নিয়ে ‘তিমবুকতু লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন’-এর কার্যালয়ে বৈঠক করেন হায়দারা। তিনি নিজেও পেশায় ছিলেন একজন সংগ্রাহক, সংরক্ষক। আর এই সংগঠনটি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৯৯ সালে।
বই বাঁচানোর সেই লড়াই সম্পর্কে হায়দারা বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল বইগুলো গ্রন্থাগারে রাখা নিরাপদ নয়। বরং সেখান থেকে সরিয়ে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে সেগুলো রাখতে পারলে হয়তো জঙ্গিদের হাত থেকে এসব অমূল্য পাণ্ডুলিপি ও বই রক্ষা করা যাবে। আমরা কোনোভাবেই চাইনি এগুলো জঙ্গিদের হাতে পড়ুক এবং তারা সেগুলো চিরতরে ধ্বংস করে দিক।’
এর কয়েকমাস পরেই নাইজেরিয়ার লাগোসে অবস্থিত ফোর্ড ফাউন্ডেশন থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলারের বৃত্তি পান হায়দারা। আর এই বৃত্তি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার জন্য। হায়দারার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ওই অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সে সময় হায়দারা ফোর্ড ফাউন্ডেশনকে অনুরোধ করেন দুর্লভ এসব বইয়ের পাণ্ডুলিপি রক্ষার্থে তিনি টাকাটা খরচ করতে চান। তিনদিনের মধ্যে অনুমতি পেয়ে যান হায়দারা। টাকা তুলে নিজের ভাতিজাকে নিয়ে গ্রন্থাগার থেকে দুর্লভ বইগুলো সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু করে দেন তিনি। তাঁদের সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজন এই কাজে সহযোগিতা করেন।
বইগুলো নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তারা কাঠ ও টিনের ট্রাঙ্ক ব্যবহার করেন। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৮০টি ট্রাঙ্কে করে নিরাপদ স্থানে বইগুলো সরিয়ে নিতেন তাঁরা। বিরতিহীনভাবে গোপনে বইগুলো সরানোর কাজ করেন তাঁরা।
আর প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও সব বই সরাতে তাদের সময় লেগেছিল আট মাস। এই সময়ের মধ্যে শতাধিক লোক যোগ দেয় হায়দারার সঙ্গে। বই সরানো, সেগুলো গুছিয়ে রাখা ও গাড়িতে করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন তাঁরা।
তিমবুকতু থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এসব বই। সড়ক ও নৌপথে বইগুলো সরিয়ে ফেলা হয় যাতে জঙ্গিরা এসব বই ধ্বংস করতে না পারে।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে জঙ্গিদের হটিয়ে দিতে হামলা চালায় ফরাসি সেনাবাহিনী। তারপরও এই সময়ের মধ্যে তিমবুকতুর চার হাজারেরও বেশি দুর্লভ বই ও পান্ডুলিপি ধ্বংস করেছিল জঙ্গিরা। তবে বাকি চার লাখের মতো বই ও পাণ্ডুলিপি রক্ষা করতে পেরেছিলেন হায়দারা ও তাঁর সঙ্গীরা।
এ বিষয়ে হায়দারা বলেন, ‘আমরা যদি সময়মতো সচেতন হয়ে নিজেদের উদ্যোগে কাজটা শুরু না করতাম তাহলে হয়তো জঙ্গিরা সবকিছুই ধ্বংস করে ফেলত। তিমবুকতুর ঐতিহ্যের আর কিছুই হয়তো অবশিষ্ট থাকত না।’