অভিমত
সন্তান জঙ্গি, বাবা-মা জানেন না কেন?
সন্তান জন্ম দিলেই কেউ বাবা বা মা হয়ে যান না। বাবা-মা হওয়া আর সন্তান জন্ম দেওয়া, দুটোর মধ্যে এক দুনিয়া ফারাক। সন্তান জন্ম একটি জৈব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া; যা তুলনামূলকভাবে সহজতর। অথচ বাবা-মা হওয়া মোটেও কোনো সহজ কাজ নয়। বরং অনেক বেশি শ্রম ও সাধনার প্রক্রিয়া। বাবা-মা একদিনে হওয়ার বিষয় নয়, হয়ে উঠতে হয়।
আমাদের সন্তানদের নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, উঠছে আরো। কেন আমাদের সন্তানরা বিপথগামী, এমন প্রশ্নের অন্ত নেই। আমি তো মনে করি, সন্তানদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে প্রশ্ন তোলা উচিত বাবা-মাকে নিয়ে। বাবা-মা, কতটা বাবা-মা? নাকি কেবলই ‘তথাকথিত’? বাবা-মা কি কোনো চাকরির পোস্ট, সন্তান হওয়া মাত্রই সেই পদে আসীন হলাম আমি?
সমাজ ও সংস্কৃতিকে যেখানে আমরা নিয়ে গিয়েছি, যাচ্ছি, তাতে সন্তানরা বিপথগামী, কুপথগামী না হয়ে উপায় আছে? বরং না হওয়া অস্বাভাবিক, হওয়াটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক সম্পর্ক কোথায়? মা-বাবার মধ্যে? বাবা জানে না মা কোথায় গেছেন, কার সঙ্গে গেছেন, কখন ফিরবেন। মাও তা-ই। একই বাড়িতে থাকেন, একত্র বাস নেই। আছে দুঃসহ বাস। বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই, ভালোবাসা নেই। সন্তান বড় হচ্ছে অশ্রদ্ধা দেখে দেখে, অবিশ্বাস দেখে দেখে। সম্পর্কের প্রতি কোনো আস্থা, শ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা ভেতরে ভেতরে ঘৃণার বাষ্প আর ক্রোধের আগুন।
অঢেল টাকা ঢাললে, যখন যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি খরচ করলে সন্তান মানুষ হবে না কেন? দামি স্কুল, বেশি মাইনে, টিউটর, টিউটরিয়াল, বিদেশি সিলেবাস সন্তান মানুষ হওয়ার কোনো নিয়ামক নয়। যদি তাই হতো, তবে বিত্তবানদের সন্তানই কেবল মানুষ হতো সমাজে।
সম্পর্ক খুব মূল্যবান জিনিস। আত্মিকতা নেই, কিন্তু আত্মীয় এ সম্পর্ক কোথাও দাঁড়ায় না। আত্মীয়তা নেই, আত্মিকতা আছে সে সম্পর্ক যোগাযোগ তৈরি করে বিনিসুতার মালার মতো। সে সম্পর্ক মূল্য দেয়, মূল্যায়ন করে। ফলে বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে না পারলে ‘কানেক্ট’ হতে না পারলে কোটি টাকা খরচ করলেও লাভ নেই।
বিত্তবান ঘরের সন্তানরা জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বিস্মিত হচ্ছেন অনেকেই। মাদ্রাসার দরিদ্র সন্তানদের দিকেই এতদিন কেবল অভিযোগের আঙুল ছিল। এখন চারপাশে এমন সব ‘গুলশানকাণ্ড’ দেখে তাদের টনক নড়েছে। আসলে উচ্চবিত্ত, বিত্তহীনতা বিষয় নয়। বিষয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতিহীনতা। আত্মপরিচয় সংকট। মাদ্রাসার ছেলেটির যে সংকট তার চেয়ে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেটির সংকট আরো বেশি। কী পড়ছে ইংরেজি মিডিয়ামে সে, খবর নিয়েছি কখনো কেউ? তার তো কোনো সংযোগই নেই দেশের সঙ্গে, দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে। না ইংরেজি, না বাংলা এমন অদ্ভুত এক ভাষায় সে কথা বলে। ভাত চেনে না, রাইস চেনে। শেকড়বিচ্ছিন্ন মানুষ, খুব সহজেই একটানে চলে যেতে পারে যেকোনো স্রোতে ভেসে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের দিকে। সে তো দেশকে ধারণই করে না। মাদ্রাসার ছেলেটি হতে চায় আরব, ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেটি হতে চায় ইংরেজ। এদের কারো মধ্যেই নেই বাংলাদেশ।
অনেকেই বলবেন, সন্তানকে তো ধর্মশিক্ষা দিচ্ছি। আমি বলব, যা দিচ্ছেন, তা আরবি শিক্ষা। বাড়িতে আরবি শিক্ষক রেখে দিয়েছেন। সে আরবি পড়তে শিখছে। প্রকৃত ধর্ম শিক্ষা নয়। ইসলামের যে মহৎ ও মহান বাণী তা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। যদি প্রবেশ করত সে উদার হতো, মানবিক হতো। মানুষের দুঃখে দুঃখী হতো, সেবা করতে পাশে দাঁড়াত মানুষের। যেকোনো বিপন্ন মানুষের। মানুষকে বিপন্ন করে তুলত না। ইসলাম সেবার ধর্ম, সহানুভূতির ধর্ম, মানবতাবাদের ধর্ম, শান্তির ধর্ম। বিদ্বেষ নয়, বিভেদ নয়, সম্প্রীতির কথা বলে এসেছে যুগে যুগে কোথায় সেই শিক্ষা, আদর্শ? সত্যিকারের শিক্ষা যদি দিয়ে থাকেন ধর্মের, ইসলামের তবে তো সে মানবিক হবে, মহৎ মহান এক মানুষ হবে- আলোকিত মানুষ।
যে আলোকিত মানুষ ছিলেন, ইসলামের পথপ্রদর্শক মহানবী (স.)। যিনি উদার ছিলেন, যৌক্তিক ছিলেন, আধুনিক ছিলেন, মানবতাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন এক অন্ধকার সময়। যিনি সব সময়ই সময়ের চেয়ে কোটি গুণ সময় এগিয়ে যাওয়া মানুষ। তাঁর আদর্শ, শিক্ষাই তো ধর্মের, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।
উৎকট এক পুঁজিবাদী সমাজে বসবাস করছি আমরা। লাভ আর লোভের চোরাবালিতে ডুবতে বসেছি। নিমজ্জিত হতে চলেছি। আদর্শ, নৈতিকতা, মানবতাবাদ বহু দূরের শব্দ। অচেনা, অপরিচিত শব্দ। সুবিচার নেই, অন্যায়ের প্রতিবাদ নেই। অবিচার আছে, লুণ্ঠন আছে, ধর্ষণ আছে। বুদ্ধিজীবী, সুশীলরা অনর্গল মিথ্যে বলে যাচ্ছে। ক্ষমতা চাই। আধিপত্য চাই। অর্থ চাই। প্রয়োজনে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিতেও আপত্তি নেই তাদের। অস্ত্রের বিক্রি বাড়াতে হবে। সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হবে। নিতে হবে খনিজের অধিকার, তা যত লুণ্ঠন, আগ্রাসী, উলঙ্গ প্রক্রিয়াই হোক না কেন? দখল করতে হবে ভূ-ভাগ।
বিকট পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হচ্ছে প্রতিটি মানুষ। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের উৎকট উপাচার হয়ে উঠছে নিজেও, নিজের অজান্তে!
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়। উপসম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি। সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশনস