দুর্গাপূজা
সম্প্রীতির আবহে শারদীয় দুর্গোৎসব
বাঙালি হলো উৎসবপ্রিয় জাতি। এসব উৎসব যে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতেই আটকে থাকে তাই নয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির বাইরে পয়লা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, চৈত্র-সংক্রান্তি, পিঠা উৎসব ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ যায় না। দুর্গাপূজা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মীয় চরিত্রটি এখন এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে সব ধর্মের রীতিনীতি পালনই এখন সার্বজনীনতা লাভ করেছে। মুসলমানদের দুটি ঈদ, খ্রিস্টানদের বড়দিন, ইস্টার সানডে, বৌদ্ধদের বুদ্ধপূর্ণিমা, হিন্দুদের শ্রীশ্রী শারদীয় দুর্গাপূজাসহ আরো অনেক পূজাপার্বণ উদযাপন এখন এতটাই সার্বজনীনতা পেয়েছে যে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্মীয় দিবসগুলোতেও অন্য ধর্মের মানুষদের দাওয়াত করে তাদের আনন্দে শরিক হওয়ার জন্য। এভাবে ধর্মে ধর্মে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও (২০১৬) দুর্গাপূজা সেভাবেই পালন করা হচ্ছে। মহালয়ার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সেই শুরুর প্রথম দিকে প্রথমা, দ্বিতীয়া, এভাবে যেতে যেতে মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে দুর্গাপূজা আরম্ভ হয়ে থাকে। সেভাবেই ৭ অক্টোবর ২০১৬ থেকে মহাষষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়েছে। তারপর একে একে মহাসপ্তমী ও মহা-অষ্টমীর দিকে অগ্রসর হয়ে প্রতিটিতেই নতুন নতুন আরাধনা ও অঞ্জলির দ্বারা বরণ করা হয়েছে মা দুর্গাকে। মহা-অষ্টমীতে কুমারী পূজার মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা হয়েছে। নবমীতে আরতি নৃত্য, পূজা অঞ্জলি, মণ্ডপে মণ্ডপে পূজারি সব বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রতিযোগিতার আয়োজন সার্বজনীন মানুষের ঢল ইত্যাদি সবাইকে একমঞ্চে এনে দাঁড় করায়।
এবারের পূজা নিয়ে একটা চাপা আতঙ্ক ছিল যে কোনো ধরনের জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে কি না। এর অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল। কারণ যে দেশের জঙ্গিরা দেশের অত্যন্ত নামকরা এবং সবচেয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকা রাজধানী কূটনৈতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশানের হলি আর্টিজান নামক রেস্তোরাঁয় পবিত্র রমজানের মধ্যে ইফতাররত অবস্থায় হামলা করে মানুষ খুন করতে পারে, যে জঙ্গিরা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় পবিত্র ধর্ম ইসলামের নামে হামলা করে নিরীহ দেশি-বিদেশি মানুষ হত্যা করতে পারে সে দেশে ও রকম আতঙ্ক হওয়াটা স্বাভাবিক। ধর্মশালার ধর্মগুরু, পুরোহিত, মসজিদের ইমাম, খাদেম, খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক, ফাদার, মসজিদ, মন্দির প্যাগোডা ইত্যাদি কোনো কিছুই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি, সেখানে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও এমন একটি অনুষ্ঠানে আক্রমণ করবে না কিংবা আক্রমণের পরিকল্পনা থাকবে না এমন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আর সাম্প্রতিক এসব ঘটনার পর সরকারি জিরো টলারেন্স নীতির কারণে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সমূলে উৎপাটনের লক্ষ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদা তৎপর রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে তারা একের পর জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত করে আক্রমণ চালিয়ে তাদের সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে সমর্থ হচ্ছে।
হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়া হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্প্রতি ঢাকার মিরপুর, কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে সফল অভিযান চালিয়ে তাদের নেটওয়ার্ক অনেটাই দুর্বল করতে সমর্থ হয়েছেন। পূজা চলাকালীন পূজার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নাশকতার হামলার পরিকল্পনার সময় ৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরেকটি যৌথ সফল অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে বিভিন্ন জঙ্গিসংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়ের ১২ জনকে ধরাশায়ী করতে সমর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ নিয়ে বিগত প্রায় নয় মাসে ৪০ জন জঙ্গিকে তাদের পরিকল্পনা ফাঁসের কারণে বন্দুকযুদ্ধে জীবন দিতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিঘ্নে দুর্গোৎসব পালনের জন্য যে কোনো ধরনের নাশকতা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য তৎপর রয়েছে।
কাজেই বিজয়া দশমীতে মা দুর্গার ১০ হাত দিয়ে যে কোনো ধরনের অসুরীয় শক্তি বিনাশ করে সত্য ও সুন্দরের জন্য বিজয় নিশ্চিত করবেন এটাই সবার প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশিত ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ দিনের অবস্থাতেই সবাই তাদের প্রতিমা বিসর্জন করবেন বলে আমাদের সবার বিশ্বাস। তাতে হয়তো অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যেতে পারে। বলা তো যায় না, কারণ কথায় আছে, সাবধানের মার নেই। পুলিশি এসব সফল অভিযানের ফলে একদিকে যেমন জঙ্গিরা তাদের পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না ঠিক সে রকম সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। সে জন্য এবারের দুর্গাপূজাতে উপচে পড়া মানুষের ভিড় সে রকমটাই জানান দেয়। আস্তে আস্তে এখন সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এবারে নির্বিঘ্নে তাই আগামী দিনে ভরসা হবে সবার জন্য।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।