যেভাবে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যব্যবস্থাপনা
আমাদের চারপাশের পরিচিত পৃথিবী খুব দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আমাদের চিন্তাধারা। জলবায়ু পরির্বতন, মহামারী, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উদ্ভাবন,বৈশ্বিক যোগাযোগের প্রভাব এসব কিছুই আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরির্বতন এনেছে। এই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশের খাদ্য ও পানীয়র পরিষেবাতেও। বাংলাদেশের খাদ্য ও পানীয় পরিষেবাতে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আগে কখনো দেখা যায়নি। এই পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে এবং নতুন ট্রেন্ডের সূচনা হয়েছে। নতুন ট্রেন্ডগুলো হল:
১. অর্গানিক ফুড: অর্গানিক ফুড বা জৈব খাদ্য হল সেসব খাবার যা জৈব সার ব্যবহার করে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন করা হয়। এসব খাবারে কোনো প্রকার রাসায়নিক সার, এন্টিবায়োটিক, হরমোন বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। বাংলাদেশের প্রতিটি খাদ্যেই অর্থাৎ মাছ-মাংস থেকে শুরু করে শাক-সবজি সবকিছুতেই রাসায়নিক সার, হরমোন, এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়্ থাকে। এসব খাবার খেয়ে মানুষ এখন অল্প বয়সেই নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু বর্তমানে মানুষ বেশ স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মহামারী পরবর্তী সময়ে এ সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।সম্প্রতি মানুষ অর্গানিক খাবারের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই অর্গানিক ফুড শুধু মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা করে না, এটি পরিবেশ রক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। কারণ এতে পবিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো সার ব্যবহার করা হয় না। বাংলাদেশে অর্গানিক খাদ্যের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় এর উৎপাদন খুব কম। এর মূল কারণ হল অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি।
২.হোম-ডেলিভারি: পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে বাজার ব্যবস্থাতেও। একটা সময় বিভিন্ন রেস্তোরা,বই, কাপড় ইত্যাদি অনলাইনে হোম-ডেলিভারি দেওয়া হতো কিন্ত মহামারী পরবর্তী সময়ে বাসায় রান্না করা খাবার থেকে শুরু করে চাল, ডাল, শাক-সবজি সবকিছুই এখন হোম-ডেলিভারি দেওয়া হয়। দিন দিন এই হোম-ডেলিভারি প্রথা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শহরের কর্মব্যস্ত মানুষ কাজের চাপে বাজারে যাওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে এই হোম-ডেরিভারির মাধ্যমে। শুধু তাই নয় দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীও এ সেবার সুবিধা ব্যবহার করছেন। যাদের সন্তান নেই বা দেশের বাইরে থাকে ,যারা অসুস্থ তারা খুব সহজেই হোম-ডেলিভারির মাধ্যমে মাসের বাজার থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত সহজেই ঘরে বসে হাতে পেয়ে যাচ্ছেন। এখন আর বাজার করার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হচ্ছে না।
৩.রেডি-টু-কুক খাবার: দ্রুতগতির জীবনযাত্রায় একটা সময় রেডি-টু-ইট খাবারের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। রেডি-টু-ইট খাবারের মাঝে রয়েছে হিমায়িত ভাত,ডাল. শাক-সবজিসহ নানা রকমের স্ন্যাকস জাতীয় খাবার, যেগুলো রেডিমেড খাবার আইটেম। এদের কিছু সময়ের জন্য সিদ্ধ বা গরম করে নিলেই খাওয়া যায়। কিন্তু এই খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে লবণ ও প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়,যার ফলে দেখা দেয় নানা শারীরিক অসুস্থতা সহ ওজন বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা।তাই ইন্সট্যান্ট নুডুলস,সসেজ,সুপ এই রেডি-টু-কুক খাবারের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে অনেকাংশে কমে এসেছে ,আর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রেডি-টু-কুক খাবার। শহরের বেশির ভাগ মানুষই বাজার থেকে মাছ-মাংস কেটে আনেন কিন্তু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনের তাগিদে এই চর্চাটাও একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। রান্নার বাজার থেকে মাছ-মাংস কিনে আনার বদলে ঘরে বসে রেডি-টু-কুক ফুড অর্থাৎ কেটে-ধুয়ে পরিষ্কার করা রান্নার জন্য প্রস্তুত খাদ্য উপকরণ কেনার প্রবণতা বাড়ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েব-সাইট এবং ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠাগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে কাটা মাছ-মাংস, শাক-সবজি থেকে শুরু করে বাটা মসলা এমনকি রান্না করা খাবার পর্যন্ত সরবরাহ করে থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারের প্রায় সবাই কর্মজীবী। যার ফলে বাসায় এসে খাবার কেটে-ধুয়ে পরিষ্কার করে রান্না করার মতো সময় বা ইচ্ছে তাদের থাকে না বললেই চলে। তাই সম্প্রতি মানুষ রেডি-টু-কুক খাদ্য উপকরণের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। রেডি-টু -কুক খাবারের বদৌলতে রান্না করা যেমন সহজ হয়ে গিয়েছে তেমনি পরিবারের সদস্যদের বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকছে। এছাড়া বাসায় ছোট বাচ্চাদের জন্য নানা ধরণের নাস্তা তৈরি করা বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে যার ফলে তাদের অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে।
৪.মাইন্ডফুল ইটিং: মাইন্ডফুল ইটিংয়ের ধারণা বাংলাদেশে ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পুষ্টিবিদদের মতে, যে খাবারই খান না কেন খাবারের সঙ্গে মনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে খাবার খেয়ে কোনো লাভ হয় না। খাবারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সহজ উপায় হলো মাইন্ডফুল ইটিং। যার নেপথ্যে রযেছে সচেতনতা। স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে অনেকে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। কেউ শুধু প্রোটিনযুক্ত খাবার খান আবার কেউ শুধু তরল খাবার খেয়ে শরীরের মেদ কমানোর চেষ্টা করেন। আবার অনেকে কাজের চাপে নাকে-মুখে দুটো ভাত গুজে অফিসের উদ্দেশ্যে দৌড় দেন। কিন্তু আপনার শরীর কি চাইছে বা যে খাবার আপনি খাচ্ছেন তা আপনার শরীরের আদৌ প্রয়োজন কি না, এইসব প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টাও মাইন্ডফুল ইটিংয়ের মধ্যে পড়ে। ক্ষুধা পেয়েছে বলে খাচ্ছেন, নাকি শুধুমাত্র চোখের ক্ষুধা থেকে খাচ্ছেন, এই বিষয়টির পার্থক্য বুঝতে হবে। পুষ্টিবিদের মতে,পরিমাণে কম খাবার খেয়েও কিন্তু মনের দিক থেকে ভাল থাকা যায়,যদি খাবারের সাথে সেই সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়। সারা দিন নিদির্ষ্ট সময় অন্তর অল্প পরিমাণে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, পাশাপাশি যে খাবারই খাওয়া হোক না কেন সেই খাবারের স্বাদ, গন্ধ,বর্ণ উপভোগ করে খেতে হবে। খাবার সব সময় চিবিয়ে মনোনিবেশ সহকারে খাওয়া অভ্যাস করতে হবে। বৈশ্বিক যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে পাশ্চাত্যের অনেক অভ্যাস আমাদের জীবনযাত্রায় মিশে যাচ্ছে। যার কিছু ভালো,কিছু খারাপ। মাইন্ডফুল ইটিং ধারণাটি পাশ্চাত্য থেকে সম্প্রতি আমাদের দেশে এসে জনপ্রিয় হলেও এই ধারণাটি কিন্ত অনেক প্রাচীন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন আয়ুর্বেদে মাইন্ডফুল ইটিং সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণণা করা হয়েছে, যা কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেলেও আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসছে। কোয়ান্টাম সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এই ধারণাটি নিয়ে কাজ করছে যার ফলে মানুষের মাঝে মাইন্ডফুল ইটিং ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এই বড় পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ছে। মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তিত হওয়ায় তারা স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-যাপনেও আগ্রহী হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তনগুলো মানুষের সামগ্রিক জীবনধারায় প্রভাব বিস্তার করছে। র্বতমানে মানুষ তাদের খাদ্যের উপাদান এবং সেটা কিভাবে তাদের শরীরকে প্রভাবিত করে তা জানতে আগ্রহী। অর্গানিক, পরিচ্ছন্ন এবং প্রাকৃতিক- এই ৩টি বিষয় এখন মানুষের খাদ্য গ্রহণের তালিকার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া