ইন্টারনেটের চেয়ে ফেসবুক বড়!
লাখ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী জানেনই না যে তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। তিন বছর আগে বিষয়টি নজরে আসে ইন্দোনেশিয়ার গবেষক হেলানি গালপায়ার! এরপর তিনি একটি জরিপ পরিচালনা করেন। জরিপ করার সময় ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকরা জানান, তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। কিন্তু যখন তাঁদের ফেসবুকের কথা বলা হলো, তখন তাঁরা বেশি উচ্ছ্বসিত! দিনের অনেকটা সময় তাঁরা ফেসবুকে কাটান। গালপায়া একজন গবেষক এবং লির্নে এশিয়া নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান।
আফ্রিকায় একই রকম অভিজ্ঞতা পেয়েছেন ক্রিস্টোফ স্টর্ক। রিসার্চ আইসিটি আফ্রিকার একটি গবেষণা করতে গিয়ে স্টর্ক দেখলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর চেয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। এমনকি ফেসবুকের হেড অব অপারেশন্স শেরিল স্যান্ডবার্গও স্বীকার করেছেন, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই জানেন না যে তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন!
অর্থাৎ ফেসবুকের অনেক ব্যবহারকারীরই ইন্টারনেট সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। ফেসবুক ব্যবহারের জন্য যে ইন্টারনেট ব্যবহার করা প্রয়োজন, সে সম্পর্কেও তাঁদের কোনো ধারণা নেই।
দুনিয়াজুড়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে তাঁরা হয়তো বা ইন্টারনেটের কথা ভুলেই যাবেন। আর পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই যদি ফেসবুকে তাঁদের সময় কাটান, তাহলে তাঁদের সাথে যোগাযোগের জন্য সবাইকে ফেসবুকেই আসতে হবে। মানে বিজ্ঞাপনের একমাত্র মাধ্যমে হবে তখন ফেসবুক।
অবশ্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আর ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা নির্ধারণের প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছুটা তফাত রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিষয়টি তদারক করে থাকে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন, যা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি সংস্থা। অন্যদিকে ফেসবুকের ব্যবহারকারীদের তথ্য আসে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে। যাঁরা ইন্টারনেটে বা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন, তাঁরাই ব্যবহারকারী বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন।
ফেসবুকের আবার কিছু কৌশলগত দিক রয়েছে। এক ব্যবহারকারীর অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে। আবার অনেক অ্যাকাউন্ট হয়তো খুবই কম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো ব্যবহারকারী শুধুমাত্র মোবাইল দিয়ে ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন ফলে তাঁরা শুধু নির্দিষ্ট কিছু কাজ করেন, অন্য কিছু নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
ইন্দোনেশিয়ার গালপায়া বা আফ্রিকার স্টর্কের গবেষণার সূত্র ধরে যদি এগোনো যায়, তাহলে দেখা যাবে এ রকম গবেষণা বা জরিপ অনেকেই করেছেন। ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়ায় একই ধরনের গবেষণা চালিয়েছে জিওপোল নামের একটি সংস্থা। ৫০০ জন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ওপর গবেষণা চালিয়েছে তারা। সবার কাছে একই প্রশ্ন ছিল, গত ৩০ দিনে তাঁরা কি ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন এবং একই সময়ে তাঁরা কি ফেসবুক ব্যবহার করেছেন?
এতে ১১% ইন্দোনেশিয়ান বলেছেন, তাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। নাইজেরিয়ায় ৯% ব্যবহারকারী বলেছেন তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। যাঁদের ওপর গবেষণা চালানো হয়েছে, তাঁরা সবাই বয়সে তরুণ। তাঁদের গড় বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর।
ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়ার মোট জনসংখ্যার তুলনায় মাত্র ৫০০ জন ব্যবহারকারী খুবই অপ্রতুল। তবে ছোট করেও হলেও এ থেকে বড় ধরনের তথ্যের আভাস পাওয়া যায়।
নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় জরিপ চালানোর সময় ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তারা ফেসবুক থেকে লিংক পেয়ে অন্য কোনো সাইটে যান কি না? এর মধ্যে যাঁদের ধারণা যে তাঁরা শুধু ফেসবুকই ব্যবহার করছেন, ইন্টারনেট নয়, তাঁরা বলছেন তাঁরা অন্য কোনো লিংক ব্যবহার করেন না। আবার যাঁরা জানেন যে তাঁরা ফেসবুক ও ইন্টারনেট দুটোই ব্যবহার করছেন, তাঁরা বলছেন, তাঁরা ফেসবুক থেকে লিংক পেয়ে অন্যান্য ওয়েবসাইটেও যান।
ফেসবুক যদি এভাবে মানুষের ভেতর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তাহলে সামনের দিনগুলোতে মানুষ হয়তো মোবাইলের দোকানে গিয়ে শুধু বলবে, ‘আমি ফেসবুক ব্যবহার করতে চাই।’ সে কথাই তুলে ধরেছেন ফেসবুকের হেড অব লোকালাইজেশন অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনালাইজেশন ইরিস ওরিস। তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে মানুষ খুব কমই জানে। অনেকের কাছে ফেসবুকই ইন্টারনেট। অনেকের মোবাইলে শুধুমাত্র ফেসবুক অ্যাপ্লিকেশনটাই খোলা হয়।’
আরো মানুষের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে ফেসবুক। আর সেজন্যই তারা ফেসবুককে আরো সহজলভ্য, আরো সস্তায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। ফেসবুকের একটি উদ্যোগ ইন্টারনেট ডট অর্গ। এর মাধ্যমে পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাঁরা এখনো এই সেবা থেকে বঞ্চিত। সে জন্য তাঁরা ফেসবুকের একটি সস্তা অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে বিনামূল্যে ফেসবুক ব্যবহার করা যাবে। ছয়টি দেশে অ্যাপটি চালু করেছে তারা।
এসব অ্যাপ্লিকেশনের সাথে নারী অধিকার, চাকরি, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং ইবোলাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ উইকিপিডিয়া বা গুগল ব্যবহার না করে এসব দরকারি বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান ব্যবহারকারীরা ফেসবুক থেকেই পাবেন।
ভারতে মাত্র আড়াই ডলারে সারা বছর শুধু ফেসবুক ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন মোবাইল ব্যবহারকারীরা। ফিলিপাইনে মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য যেসব ট্যারিফ রয়েছে তার অর্ধেকই শুধু ফেসবুক ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়ে থাকে। ঘানার টেলিকম অপারেটর টিগো একবার ‘ফেসবুক ফোন’ বাজারে ছেড়েছিল। সেই হ্যান্ডসেটে ফেসবুক ব্যবহারের জন্যই একটি আলাদা বাটন রাখা হয়েছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও শুধু ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহারের জন্য আলাদা ইন্টারনেট প্ল্যান রয়েছে।
প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট দি আটলান্টিকে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে ফেসবুক যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আর মানুষের প্রতিদিনের জীবনে জায়গা করে নিচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে দুনিয়া জয় করেই থামবে এর জয়যাত্রা।