বিশ্বকাপের প্রযুক্তি গ্যালারি থেকে ঘরে

বলটা শূন্যে! ছয় হবে না চার? নাকি ক্যাচ আউট? গ্যালারিতে বসা একজন দর্শক যেমন উত্তেজনায় ‘হা’ করে তাকিয়ে আছেন, আপনিও তেমনি সোফায় আধ শোয়া থেকে সোজা হয়ে বসেছেন। মনে হচ্ছে আপনিও গ্যালারিতে। এই যে যা ঘটছে তাই সরাসরি দেখছেন, এটা তো প্রযুক্তির কল্যাণেই। এর পেছনে রয়েছে সম্প্রচার কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম। বিশ্বজুড়ে ২০০টি দেশে আড়াই শ কোটি মানুষ টিভির কল্যাণে সরাসরি খেলা দেখতে পাচ্ছেন।
এবার বিশ্বকাপের খেলাগুলো সম্প্রচার করা হচ্ছে এইচডি অর্থ্যাৎ হাই ডেফিনেশন প্রযুক্তিতে। এর মধ্যে সাতটি ম্যাচ দেখানো হবে ফোরকে প্রযুক্তিতে। বিশ্বকাপে এটাই প্রথম ফোরকে প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে পৃথিবীর সব দেশ থেকে ফোরকে প্রযুক্তিতে খেলা দেখা যাবে না। স্টার স্পোর্টস এবারের বিশ্বকাপের সম্প্রচারের দায়িত্ব পালন করছে। এনডিটিভির বরাতে চলুন জেনে নেওয়া যাক তাদের সম্প্রচার প্রযুক্তি ও পদ্ধতি সম্পর্কে।
ক্যামেরার কারসাজি
টিভিতে আমরা যা দেখি সবই ক্যামেরার চোখে। এবারের বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে কমপক্ষে ২৯টি ক্যামেরা থাকবে মাঠে। প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ও প্রযুক্তির ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। মাঠের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা বসিয়ে খেলাকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। থাকছে বিভিন্ন লেন্সের ক্যামেরা। বাউন্ডারি লাইনের ক্যামেরাগুলোতে থাকছে জুম লেন্সের ক্যামেরা। যার ফলে চার বা ছয়ের সিদ্ধান্ত নিতে থার্ড আম্পায়ারের কোনো ভুল হবে না। স্ট্যাম্প এবং পিচে রয়েছে ফিক্সড ক্যামেরা।
ক্রিকেটারদের সবসময় নজরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আলট্রামোশন ক্যামেরা। এগুলো সবই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্যামেরা যা দিয়ে দ্রুতগতির বস্তুর ছবি তোলার পর তাকে আবার স্লো মোশনে অর্থাৎ ধীরগতির করে দেখা যাবে। তবে ধীরগতিতে চালানোর সময় ছবির মান নষ্ট হবে না বা ফেটে যাবে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে সুবিধা হবে। দর্শকরাও তাদের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
আপনি যদি আরো আগ্রহী হন তাহলে আলট্রামোশন ক্যামেরার ব্যাপারে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা নিতে পারেন। ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে আপনার প্রিয় অনুষ্ঠানগুলোতে আলট্রামোশন ক্যামেরার বহুল ব্যবহার রয়েছে। যেমন : স্নাইপার রাইফেল দিয়ে টমেটো ফুটো করার দৃশ্যগুলো বারবার স্লো মোশনে দেখানো হয়, সেটা আলট্রামোশন ক্যামেরার কল্যাণেই।
আলট্রামোশন ক্যামেরার পর আসুন স্পাইডারক্যাম বা মাকড়সা ক্যামেরা। বিশ্বকাপের ৪৯টি খেলার মধ্যে ১৩টি খেলাতে ব্যবহার করা হবে এই মাকড়সা ক্যামেরা! স্পাইডারক্যামের অন্য নামও রয়েছে স্কাই-ক্যাম। ওপর থেকে মাঠের যে দৃশ্যগুলো আমরা দেখতে পাই সেটা স্পাইডারক্যামেই তোলা। পাখির নজরে খেলা দেখতে (বার্ডস আই ভিউ) ব্যবহার করা হয় স্পাইডারক্যামে। স্কাই ক্যাম আর স্পাইডারক্যামের মধ্যে পার্থক্য হলো স্কাই ক্যাম স্বাধীনভাবে উড়তে পারে আর স্পাইডারক্যাম বাধা থাকে পাতলা তারের সাথে। তারে ঝুলে সারা স্টেডিয়ামের ছবি তুলতে পারে স্পাইডারক্যাম। ত্রিমাত্রিক এসব ক্যামেরার রয়েছে দ্রুতগতিতে নিখুঁত ছবি তোলার ক্ষমতা। দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায় স্পাইডারক্যামকে।
তবে স্পাইডারক্যামের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন স্টিভ স্মিথ এক ম্যাচে অভিযোগ করেছিলেন চ্যানেল নাইনের স্পাইডারক্যামের কারণে সোজা একটি ক্যাচ মিস করে ফেলেছিলেন তিনি। সে কারণেই স্পাইডারক্যামের ব্যবহার সীমিত করেছে স্টার স্পোর্টস।
আরেকটি ক্যামেরা প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে। নক আউট ম্যাচগুলোতে ব্যবহার করা হবে ড্রোন ক্যামেরা। এটা আকাশে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে আর পুরো স্টেডিয়ামের ছবি তুলে ধরবে। আর প্র্যাকটিস প্যাডে ক্রিকেটারদের সানগ্লাস এবং উইকেটে থাকবে ছোট ক্যামেরা। এতে খেলার সময় খেলোয়াড়দের মনোযোগ কোথায় থাকে তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।
স্মার্ট স্ট্যাম্পস
ক্যামেরার কারসাজি ছাড়া আরো কিছু নতুন প্রযুক্তি যোগ হয়েছে এবারের খেলায়। কাঠের স্ট্যাম্পগুলো এখন আর আগের জড় পদার্থ নেই। এবারের মাঠে থাকবে এলইডি স্ট্যাম্প। স্ট্যাম্পকে নাড়ানো হলেই জ্বলে উঠবে বাতি। রান আউট, স্ট্যাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আম্পায়ারের স্বাক্ষী হবে এসব স্ট্যাম্প।
আম্পায়ারদের কানে গোজা থাকবে রিয়েল টাইম স্নিকো। এর মাধ্যমে আম্পায়ররা পিচের অতি সূক্ষ্ম শব্দও স্পষ্ট শুনতে পারবেন। ব্যাটসম্যানের গায়ে না ব্যাটে বল লেগেছে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে আম্পায়ারদের জন্য। এর সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন থার্ড আম্পায়ার। ছবির সাথে শব্দ মিলিয়ে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তিনি।
স্নিকোর কাজ অবশ্য বেশ সোজা। এটা প্রথমে শব্দকে শনাক্ত করবে এবং শব্দ তরঙ্গকে বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাটে বল লাগার শব্দকে আলাদাভাবে শনাক্ত করবে।
গ্যালারি থেকে ঘরে
অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের ১৪টি স্টেডিয়াম থেকে সরাসরি দেখানো হবে ৪৯টি খেলা। গ্যালারি থেকে আপনার ঘরে সবগুলো খেলা সরাসরি পৌঁছে দিতে কাজ করছে স্টার স্পোর্টসের চারটি আলাদা প্রোডাকশন টিম। প্রত্যেক টিমের কাছে রয়েছে সাত ধরনের আলাদা প্রযুক্তি। তবে খেলার সময় সব প্রোডাকশন টিমই সব ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
সবার সাথে থাকবে আলাদা গ্রাফিক্স টিম, যারা খেলোয়াড়দের তথ্য উপাত্ত এবং পরিসংখ্যান পর্দায় তুলে ধরবে। চার হাজার ঘণ্টার ফুটেজ সংরক্ষণের সুবিধা পাবে প্রোডাকশন টিমগুলো। আর সব ক্যামেরা থেকে বাছাই করা সেরা ছবিগুলোই টিভিতে দেখতে পাবেন দর্শকরা। ক্যাবল প্রোভাইডারদের কাছে এসব ছবি পৌঁছে যাবে ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) ডিশ প্রযুক্তির মাধ্যমে।