ডিপসিক : এআইয়ের দুনিয়ায় চ্যাটজিপিটি ও জেমিনির লড়াকু প্রতিপক্ষ
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে শুরু থেকেই আধিপত্য বিস্তার করে আছে চ্যাটজিপিটি। এছাড়া গুগলের জেমিনি ও অ্যানথ্রপিক ক্লডের মত কয়েকটি নামও বেশ পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু তাদের কেউই ওপেন এআইয়ের এই সেবাটির সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি।
তবে এবার এআই যুদ্ধে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে চীনা প্রতিষ্ঠান ডিপসিকের। কারিগরি বৈশিষ্ট্য ও বাজারে যুগান্তকারী প্রভাবের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে এই পরিষেবাটি। চলুন, চ্যাটজিপিটিসহ সমসাময়িক প্রতিযোগীদের মাঝে ডিপসিকের অবস্থানটি পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
ডিপসিক
এই উন্নত এআই মডেলটির নামকরণ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নামেই। চীনের জেজিয়াং প্রদেশের রাজধানী শহর হ্যাংজোর একটি গবেষণাগারে চলে এর উন্নয়নের কাজ। ২০২৩ সালের মে থেকে কাজটি শুরু করেন প্রকৌশলী লিয়াং ওয়েনফেং। গ্রাফিক্স কার্ডের জন্য বিশ্বব্যাপি সুপরিচিত মার্কিন প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া থেকে বিপুল সংখ্যক চিপ জমা করছিলেন ওয়েনফেং। বিশ্লেষকদের দাবি, সংগ্রহে থাকা এই চিপগুলো কাজে লাগিয়েই তিনি ডিপসিক বানিয়েছেন। চিপগুলো যথেষ্ট কম দামি হওয়ায় অনেক কম খরচেই মডেলটি চূড়ান্তভাবে ব্যবহারযোগ্য একটি সেবায় রূপ লাভ করে।
ডিপসিকের মডেলটি ওপেন-সোর্সভিত্তিক। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি অ্যাপল ও অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ হিসেবে ছাড়া হয় ডিপসিকের প্রথম সংস্করণ আর ১। ২৭ জানুয়ারি নাগাদ এটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপল অ্যাপ স্টোর থেকে বিনামূল্যে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা অ্যাপ হিসেবে চ্যাটজিপিটিকে ছাড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, চীনসহ যুক্তরাজ্যের কয়েকটি দেশেও এই চ্যাটবট অ্যাপটি চ্যাটজিপিটির তুলনায় বেশিবার ডাউনলোড করা হয়েছে।
তাই সিলিকন ভ্যালিসহ গোটা এআই দুনিয়াকে এটি নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে বলে দাবি করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত এআই পরিষেবাগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ডিপসিককে এখন উদীয়মান এআই হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এতদিন ধরে চ্যাটজিপিটির একচেটিয়া কর্তৃত্বকে হুমকির মুখে ফেলে ডিপসিক এআই প্রতিদ্বন্দিতার এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছে।
সমসাময়িক এআই মডেলগুলোর সঙ্গে ডিপসিকের তুলনা
উন্নয়ন খরচ
ডিপসিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে এর বাজেট-বান্ধব প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া। ১০ হাজার এনভিডিআ জিপিইউয়ের ওপর আর ১ মডেলটির বিকাশ ঘটাতে প্রয়োজন হয়েছিলো মাত্র ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।
এটি ওপেনএআই, মেটা (সাবেক ফেসবুক) ও গুগলের উন্নয়ন খরচ থেকে অনেক কম। সঙ্গত কারণেই এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক ব্যবহৃত এআই অ্যাপে পরিণত হয়। এতে করে রাতারাতি মোড় ঘুরে যায় এআই নির্ভর ইন্ডাস্ট্রির। এই ধাক্কার শিকার হয়েছে মেটা ও মাইক্রোসফ্টসহ অনেকগুলো এআই প্রতিষ্ঠানের। এই তালিকায় রয়েছে- স্বয়ং এনভিডিআও, যেখানে স্টকের দাম পড়ে গেছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
পারফর্মেন্সের দিক থেকে বিশ্বখ্যাতি থাকলেও চ্যাটজিপিটি ও জেমিনি প্রশিক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ যথেষ্ট বেশি। অন্যদিকে ডিপসিক কম খরচে প্রায় সমপরিমাণ সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। এটি বদলে দিচ্ছে যে পদ্ধতিতে এআইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার ন্যায্যতার হিসাব।
পারদর্শিতা
কোনও প্রশ্ন করা হলে ডিপসিক আর ১ প্রথমে তার উত্তর তৈরি করার প্রক্রিয়াটি ব্যবহারকারির সঙ্গে শেয়ার করে। এখানে থাকে উত্তর প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজনীয় যুক্তি ও সামঞ্জস্যপূর্ণতা। এখানে কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হলে ব্যবহারকারি তার নির্দেশনা দিয়ে দেন। তারপর চূড়ান্ত নিদের্শনার ওপর নির্ভর উত্তরটি সরবরাহ করা হয়। এতে করে উত্তরের নির্ভুলতা ও প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকে। সহজ ভাষায় ডিপসিক কাজ দেখানোর পূর্বে সে কিভাবে কাজটি করবে তার একটা খসড়া নিয়োগকর্তাকে দেখিয়ে নেয়। অন্যদিকে, চ্যাটজিপিটি নিজে থেকেই পুরো কাজটি সম্পন্ন করে। সর্বশেষ হালনাগাদকৃত সংস্করণে এটি আরও পরিণত হয়েছে। তাছাড়া প্রিমিয়াম ক্যাটাগরিগুলো আরও ভালো পারফর্মেন্স দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে শুরুর দিকে চ্যাটজিপিটির অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে ডিপসিক অনেকটা এগিয়ে থাকবে।
গ্রহণযোগ্যতা
প্রতি মুহুর্তে ডিপসিকের ক্রমবর্ধমান ডাউনলোড সংখ্যার ক্রমাগত গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে প্রকাশ করছে। মুক্তির মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই এর মোবাইল অ্যাপটির ২৬ লাখ ডাউনলোড হয়। এখন পর্যন্ত এটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপের তালিকার শীর্ষে ও বিশ্ব জুড়ে ১১১টি দেশে শীর্ষ ১০ অ্যাপে মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে, ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপি একটি বিশ্বস্ত নাম হয়ে ওঠায় প্রতি মাসেই চ্যাটজিপিটির ডাউনলোড সংখ্যা থাকে কয়েক মিলিয়ন এর পেছনে অবশ্য মুক্তির সময় অভূতপূর্ব সেবা হওয়া ও বিভিন্ন প্রযুক্তিগত পরিষেবাগুলোর সঙ্গে এর সমন্বয়ও দায়ী।
বিচার-বিবেচনা
তৈরিকৃত লিখিত কন্টেন্টের ধরণ কেমন হবে তা নিয়ে প্রতিটি এআই মডেলেরই কিছু স্বতন্ত্র বিবেচনা পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু চ্যাটজিপিটি ও জেমিনির ব্যাপারে এখন পর্যন্ত পক্ষপাতিত্বের কোনো অভিযোগ মেলেনি।
শুরু থেকেই এগুলো স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও বিতর্কিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণতা বজায় রেখেছে। এই নৈতিক অবস্থান বিশ্ব বাজারে তাদের বস্তুনিষ্ঠ কন্টেন্ট ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
কিন্তু ডিপসিককে নিয়ে এই সূচনালগ্নেই একটি সমালোচনার অবতারণা ঘটেছে। আর তা হচ্ছে- চীনের ঐতিহাসিক তিয়েনানমেন স্কয়ার বিক্ষোভ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে আর ১ তা এড়িয়ে যায়। এমন পক্ষপাতমূলক বৈশিষ্ট্য নিয়েই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে ডিপসিক। এরই রেশ ধরে নিকট ভবিষ্যতে এআই সেবা প্রদানে সীমিত অনুশীলনের আশঙ্কা থাকছে, যা উন্মুক্ত তথ্য প্রবাহের অন্তরায়।
প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা
মুক্তির পরপরই ডিপসিকে বড় আকারের কিছু সাইবার আক্রমণ চীনের বাইরের ব্যবহারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি অ্যাপটির ব্যবসার ক্ষেত্রে সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও নিয়মিত হালনাগাদকরণ এই বাধা অতিক্রমে কার্যকর হতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চ্যাটজিপিটি ও জেমিনির পাশাপাশি অন্য এআই মডেলগুলোও নিজেদের আপগ্রেড করবে। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সাশ্রয়ী খরচে এআইয়ের উন্নয়ন সাধনের জন্য চীনের সঙ্গে সমন্বয় করতে সহমত পোষণ করেছে। সর্বপরি, উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহক উভয়ের জন্যই ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে এমন প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হওয়ার এক সুদূরপ্রসারি প্রভাব রয়েছে।
ইতিবাচক ও গঠনমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌলতে তৈরি হয় সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষাপট। এতে করে একদিকে যেমন ব্যবসাগুলোর প্রান্তিক লাভ বাড়ে, অপরদিকে তেমন সাধারণ মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতিও উন্নত হয়।