রাসায়নিক বিষাক্ততা জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই বড় হুমকি: গবেষকদের সতর্কতা

জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই মানবজাতি ও জীবজগতের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে রাসায়নিক দূষণ (বিষাক্ততা)। অথচ সারা বিশ্বে এই বিষয়ে আলোচনার পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোটায়। সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রাসায়নিক দূষণ নিয়ে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিপ সায়েন্স ভেঞ্চার্স (ডিএসভি) প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি এ পর্যন্ত ১০ কোটিরও বেশি ‘নভেল এন্টিটি’—অর্থাৎ প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে অনুপস্থিত নতুন রাসায়নিক উপাদান তৈরি করেছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার উপাদান বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণা অনুযায়ী, এসব রাসায়নিক উপাদান জীবমণ্ডলে ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করছে। ফলে মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তবে অনেকের কাছেই এই বিষয়টি অজানা।
গবেষণার অন্যতম লেখক হ্যারি ম্যাকফারসন বলেন, ‘অনেকেই ধরে নেন, আমরা যে খাদ্য, পানি, প্রসাধনী বা গৃহস্থালি সামগ্রী ব্যবহার করি, সেগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে পর্যাপ্ত গবেষণা ও দায়িত্বশীলতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।’
প্রতিদিনই দূষিত হচ্ছে মানবদেহ
গ্রানথাম ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে আট মাস ধরে পরিচালিত এই গবেষণায় জানা গেছে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও মোড়কজাতকরণে ব্যবহৃত উপকরণ থেকেই ৩ হাজার ৬০০–এর বেশি কৃত্রিম রাসায়নিক মানুষের দেহে শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৮০টি উপাদান স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটি মানুষের দেহে ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক’ নামে পরিচিত পিএফএএস পাওয়া গেছে। এমনকি বৃষ্টির পানিতেও এসব রাসায়নিকের মাত্রা অনেক জায়গায় নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বিষাক্ত বায়ু শ্বাস নিচ্ছেন।
গর্ভপাত থেকে ক্যানসার পর্যন্ত, সর্বত্র হুমকি
গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সাধারণ ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে মানুষের প্রজনন, রোগপ্রতিরোধ, স্নায়ুবিক, হৃদ্যন্ত্র, শ্বাসপ্রশ্বাস, লিভার, কিডনি ও বিপাক প্রক্রিয়ার সমস্যার সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে কীটনাশকের সংস্পর্শে আসা ও প্রজনন সমস্যার মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।
পরীক্ষা পদ্ধতিতে ত্রুটি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে রাসায়নিক উপাদানের বিষাক্ততা নিরূপণে প্রচলিত পদ্ধতিগুলো পর্যাপ্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতি বাস্তব ক্ষতি শনাক্তে ব্যর্থ হচ্ছে।
ম্যাকফারসন বলেন, ‘বিশেষ করে যেসব রাসায়নিক হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, তাদের প্রভাব অনেক সময় খুবই অল্প মাত্রাতেই শুরু হয়। প্রচলিত “ডোজ বাড়লে প্রভাব বাড়ে” ধারণা এখানে প্রযোজ্য নয়।’
ভোক্তা সচেতনতা বদলে দিতে পারে পরিস্থিতি
রাসায়নিক দূষণ মোকাবিলায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিএসভি বিষয়টিকে শুধু গবেষণার ক্ষেত্র নয়, বরং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সমস্যা সমাধানে উদ্যোক্তাদের সম্ভাব্য খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গবেষকেরা বলছেন, রাসায়নিক বিষাক্ততা মোকাবিলায় বরাদ্দকৃত অর্থ অত্যন্ত কম, যা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত খাতের তুলনায় বৈষম্যপূর্ণ। এ বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
ম্যাকফারসনের মতে, রাসায়নিক বিষাক্ততা নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘এর কিছু দিক তুলনামূলকভাবে সহজে সমাধানযোগ্য।’
‘ভালো দিক হলো—এটি অনেকটাই ভোক্তানির্ভরভাবে সমাধান করা সম্ভব, যদি মানুষ তাদের কেনা পণ্যের বিষয়ে সচেতন হন। এর জন্য বিশাল সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন নেই, শুধু নিরাপদ পণ্যের চাহিদা তৈরি করলেই যথেষ্ট,’ বলেন তিনি।
তবে অর্গানিক খাবার তুলনামূলকভাবে দামী হওয়ায়, ম্যাকফারসনের পরামর্শ—কমপক্ষে ফল ও সবজি ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া উচিত। সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই অর্গানিক খাবার বেছে নেওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। পাশাপাশি, নিরাপদ বিকল্প ও সবুজ রসায়নে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।
তারা সতর্ক করে বলেছেন, এই রাসায়নিক বিষক্রিয়া নীরব ও অদৃশ্যভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হতে পারে, যা মানবজাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।