মৃৎশিল্পের সন্ধানে বাউফলে

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার পাল পাড়া। এটি উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকেই পালপাড়া নামে পরিচিত এ গ্রামটি। প্রায় ২৭০ ধরে বংশপরম্পরায় এখানে পালেরা মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে আসছেন। এ পালপাড়া ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষী ও ঐহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতির ধারণ করে। পালপাড়ার মাটির শিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে ৭০’র দশকে। কারুশিল্পীরা নান্দনিক কারুকার্যে মাটির নানা পণ্য তৈরি করে থাকেন। এসব মাটির মাটির পণ্য দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিয়েছেন। ইউরোপ আমেরিকা ও জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে পালপাড়ায় তৈরি মাটির পণ্য। এ মৃৎশিল্পের সুখ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া।

পাল পাড়ার ইতিহাস
১৭৫৬ সালে ভারত বর্ষে মুঘল শাসন চলছিল। তখন মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ছিল। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজউদৌলা নবাব হন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেন। এতে বাংলায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি। খুলনা অঞ্চলেও এর প্রভাব পরে। যে কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রুপ কুমার পাল ও মোহন চাঁদ পাল নামে দুই ভাই দুইটি নৌকায় তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পটুয়াখালীর বাউফলে চলে আসেন। বর্তমান মদনপুরা ইউনিয়নে আলোকি নদীর পাড়ে তারা বসতি গড়ে তুলেন। তারা মাটির থালা, বাসন, হাড়ি, পাতিল, জালের চাকা তৈরি করতেন। এ অঞ্চলের মানুষ তাদের কাছ থেকে এসব মাটির জিনিস কিনে নিতেন। সময়ের পরিক্রমায় তারা মানুষের প্রয়োজনে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে থাকেন। শত বছর পরেও উত্তরসুরীরা তাদের আদি পুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন। সময়ের চাহিদা মেটাতে এ মৃৎ শিল্প আধুনিকায়ন হয়। এখন এখানে ২০টি পরিবার মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজ করছেন। পারিবারিকভাবে অনেকে মৃৎ শিল্পের পণ্য তৈরি করে থাকেন। কয়েকটি কারখানাও রয়েছে। সেখানে শতাধিক কারুশিল্পীরা কাজ করে থাকনে।

কাদামাটির মাটির পণ্যে শৈল্পিক কারুকার্য
৬০’র দশক পর্যন্ত পালপাড়ায় সনাতনপদ্ধতিতে মাটির পণ্য তৈরি হতো। তারা থালা, বাসন, কলস, পাতিল, হাড়ি ও জাজরসহ কয়েক জিনিসপত্র তৈরি করতেন। ৬০’র দশকে এ শিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। কারুশিল্পীদের জীবন মান উন্নয়নে এগিয়ে আসে কারিকা নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন পাকিস্তানের গর্ভনরের স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। কারিকা তখন প্রান্তিক মানুষ নিয়ে কাজ করছিলেন। ১৯৬৪ সালের দিকে অর্চুতা নন্দন পালের ছেলে বিশ্বেস্বর পালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কারিকা। কারিকার সহযোগিতায় বিশ্বেস্বর পাল তার পূর্বপুরুষদের পেশায় নান্দনিকতা যুক্ত করেন। মাটির পণ্যে আনেন বিচিত্রতা। তৈরি শুরু করেন নানা ডিজাইনের প্লেট, থালা, বাটি, জগ, গ্লাস, কাপ পিরিচ, চামচ, ডিনার সেটসহ লোকজ সংস্কৃতির বিভিন্ন শো-পিস। তার তৈরি মাটির পণ্যে ফুটে উঠে শৈল্পিক সব চিত্রকর্ম।

দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা এমন সব শো-পিস ও পণ্য। তৈরি করা হয় মুসলিম ধর্মের আল্লাহ নাম খোদাই শোপিস সহ কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমাসহ বিভিন্ন মনীষীদের ভাস্কর্যও তৈরি করে তারা। দেশ স্বাধীনের পর বিশ্বেস্বরের পাশে দাড়ায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন ( বিসিক)। বিসিক বিশ্বেস্বর পালকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে সহায়তা করেন। পরিবারের সদস্য ও কয়েকজন স্থানীয় নারী পুরুষ নিয়ে আধুনিক সব পণ্য তৈরি করেন তিনি। বাজারে চাহিদা বাড়তে থাকে এসব পণ্যে। তার দেখাদেখি বরুণ পাল, বিমল পাল ও কমল পালসহ অনেকে আধুনিকা মৃৎ শিল্পের কাজ শুরু করেন। পালপাড়ায় গড়ে উঠে একাধিক কারখানা। পাল পাড়ায় বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে মৃৎ শিল্পের পণ্য বিক্রি করা হয়ে থাকে। দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয় সব পণ্য। দৃষ্টি নন্দন মৃৎ পণ্য মাটির মনকাড়ে। দূরদূরান্ত থেকে পাল পাড়ায় ঘুরতে আসা দর্শানর্থীরা এসব পণ্য কিনে থাকেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারে আসে সরাসরি কারখানা থেকে পণ্য কিনে নিয়ে যান।
বাউফলের মাটির পণ্যে বিশ্বজয়
১৯৮১ সালে আড়ং বাউফলের পাল পাড়ার মাটির তৈরি পণ্য ইউরোপের বাজারে রপ্তানী করে। মাটির তৈরি ডিনার সেট ইউরিপিয়ানদের নজর করে। চাহিদা বাড়তে থাকে ইউরোপের বাজারে। ১৯৮২ সালে কারিতাস নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান পালপাড়া থেকে মাটির পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা শুরু করে। সময়ের পরিক্রমায় দেশের বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি পাল পাড়ার মৃৎ পণ্য বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকেন। এ মাটির পণ্য ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা, জাপান, দুবাই, জার্মানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এতে মৃৎ শিল্প যেমন আধুনিকায়ন হচ্ছে, তেমন পেশার সঙ্গে জড়িতরা লাভবান হচ্ছে। অপরদিকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন।

পালপাড়ায় যা যা দেখবেন
পাল পাড়া জুড়ে মাটির পণ্য তৈরি করছেন শতাধিক নারী পুরুষেরা। বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা করখানায় কাজ করছেন এ মাটির শিল্পীরা। কেউ কাঁদামাটির প্রস্তুত করছেন। সেই মাটি চাকাতে ঘুরাচ্ছেন কারুশিল্পীরা। চাকায় ঘুরে কাদামাটি রূপ নেয় বিভিন্ন পণ্যে। শিল্পের দক্ষ হাতে পণ্যের প্রথম ধাপ শেষ হয় চাকায়। এ মাটির তৈরি পণ্য রোদে শুকাতে নিয়ে যায় শ্রমিকেরা। পাল পাড়ার রাস্তার পাশে বাড়ির আঙ্গিনায় রোদে শুকানো এসব মাটির পণ্য। মাটিতে শুকানোর পর এসব পণ্য/ শো-পিস নারী কারুশিল্পীরা শৈল্পিক রূপ দেয়। নিপুণ হাতে বাহারি ডিজাইন ফুটিয়ে তুলেন নারীরা। বিভিন্ন বয়সের নারী তাদের দক্ষ হাতে নিপুন ছোয়ায় এ ডিজাইন পুটিয়ে তুলে। ডিজাইন শেষে এসব পণ্য পুনরায় শুকানো হয়। রোদে শুকানো পণ্যে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি রঙ মাখা হয়। সবশেষ পুরোপুরি নান্দনিক পণ্যে রূপ নেয়। এসব পণ্য বিশাল আকৃতির মাটির চুলায় পোড়া হয়। আগুনে পোড়া শেষে বিক্রির জন্য প্যাকিং করা হয়। কাঁদামাটি থেকে এসব পণ্য তৈরির মহা কর্মযজ্ঞ দেখে মুগ্ধ হয় দর্শনার্থীরা। বিশেষ করে মাটির পণ্যে কারু শিল্পীর বাহারি ডিজাইনের কারুকার্য সুন্দর, মনোমুগ্ধকর। এসব পণ্য কারখানায় সাজিয়ে রাখা হয়। পুরো পালাপাড়া জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাটির পণ্য।

যেভাবে যাবেন বাউফলের পাল পাড়ায়
পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে প্রায় ২৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ পালপাড়া। বাউফল উপজেলা পরিষদ থেকে পশ্চিমে দুই কিলোমিটার দূরে বাউফল বাস স্ট্যান্ডের উল্টোপাশে খালের ওপর এ পালপাড়া। সারাদেশ থেকে সড়ক ও নৌপথে খুব সহজেই পাল পাড়ায় আসা যায়। বরিশাল থেকে সড়ক পাল পাড়ার দুরত্ব ৫৭ কিলোমিটার। বরিশাল থেকে সড়ক পথে পায়রা সেতু হয়ে দুমকি উপজেলা হয়ে বগা ফেরিঘাটে আসতে হবে। বগা ফেরি পাড় হয়ে বগা ফেরিঘাট থেকে একই সড়কে পাল পাড়া আসা যায়। ঢাকা থেকে নৌ পথে পাল পাড়ায় আসা যায়। সদর ঘাট থেকে পঢাকা- নুরাইনপুর-কালাইয়া লঞ্চ যোগে কালাইয়া লঞ্চঘাটে আসতে হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় থাকা সদর থেকে বিলাস বহুল ডাবল ডেকার লঞ্চ ছাড়ে। এসব লঞ্চ সকাল ৫টা থেকে ৬টার দিকে কালাইয়া ঘাটে পৌঁছায়। কালাইয়া লঞ্চঘাট থেকে অটোরিকশা জনপ্রতি ২৫ টাকার ভাড়া। ভাড়ায়চালিত মটরসাইকেলেও যাওয়া যায়। এতে জনপ্রতি ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ টাকা। নুরাইনপুর লঞ্চঘাটে নেমেও পাল পাড়ায় যাওয়া যায়। এ ছাড়াও ঢাকা- পটুয়াখালী নৌরুটেও আসায়। ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা লঞ্চে বগা লঞ্চঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে যাত্রী পরিবহনের বিভিন্ন অটোরিকশা মটরসাইকেলে আসা যাবে। অটোরিকশায় জনপ্রতি ৫০টাকা, মটরসাইকেলে ১০০টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।
যেখানে থাকবেন
পাল পাড়ার পাশে উপজেলা শহর। শহরে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেখানে থাকা যায়। বাউফল থানার পাশে সরকারি ডাকবাংলো রয়েছে। সেখানেও থাকা যায়। এতে খচরও কম। খাবারের জন্য শহরের অনেক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেল বাংলা খাবারসহ চাইনিজ খাবার পাওয়া যায়।