ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইরানে বিধ্বস্ত হয়েছিল ইউক্রেনের বিমানটি, বলছে কানাডা
তথ্য-প্রমাণ ইঙ্গিত করছে, তেহরানে ১৭৬ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমানটি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই ভূপাতিত হয়েছে—এমনটাই বলছেন পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা। মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের বিমানটি গত মঙ্গলবার রাতে বিধ্বস্ত হলে সব আরোহী নিহত হন। এ দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও বিশদ তদন্ত করার দাবি জানিয়েছে কানাডা ও যুক্তরাজ্য।
ইরানের রাজধানী থেকে উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পরই ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ সিরিজের বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ৬৩ জন কানাডার নাগরিক ছিলেন।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, তাঁর কাছে একাধিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ইঙ্গিত করছে, ভূমি থেকে বাতাসে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমানটি ভূপাতিত হয়েছে। তবে তা অনিচ্ছাকৃতও হতে পারে বলে জানান ট্রুডো।
ট্রুডো বলেন, ‘একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের প্রয়োজন। কানাডার জনগণের মনে প্রশ্ন জেগেছে এবং তারা এসব প্রশ্নের জবাব প্রাপ্য।’
তবে ট্রুডো বলেন, এখনই কারো ওপর দোষ চাপানো কিংবা কোনো উপসংহার টানার সময় আসেনি। এ ছাড়া গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য-প্রমাণের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান ট্রুডো।
দুর্ঘটনার বিষয়ে ইরানের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত বুধবার বলেছিলেন, ওই বিমানে থাকা ১৩৮ যাত্রী কানাডায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। যাঁদের মধ্যে আন্তর্জাতিক অনেক শিক্ষার্থী ছিলেন, যাঁরা কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন।
ট্রুডো জানান, তেহরানের কাছে ওই দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা সব আরোহী নিহত হয়েছেন এবং এ দুর্ঘটনার বিষয়ে ইরান নেতৃত্বাধীন তদন্তকাজে অংশ নেওয়ার জন্য কানাডা সরকার তেহরানকে চাপ দিচ্ছে।
তবে ২০১২ সালে ইরানে অবস্থিত কানাডা দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া ও তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করার ফলে তাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া কঠিন হবে বলেও জানান ট্রুডো।
এদিকে, ট্রুডোর দাবিতে সহমত পোষণ করেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও। তবে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমান ভূপাতিত হওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছে ইরান।
গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে প্রথমে পশ্চিম ইরাকের আল-আনবার প্রদেশের আল-আসাদ মার্কিন বিমানঘাঁটিতে এবং পরে মধ্য ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকা ইরবিলের মার্কিন বিমানঘাঁটিতে এক ডজনের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ওই হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই তেহরানে বিধ্বস্ত হয় ইউক্রেনের বিমানটি। বিমান চলাচলের খবরাখবর রাখা ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইটগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তেহরানের ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় গত বুধবার ভোর ৬টা ১২ মিনিটে ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ফ্লাইট-৭৫২ উড্ডয়ন করে। এর প্রায় আট মিনিট পর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
মার্কিন গণমাধ্যমগুলো তাদের পর্যবেক্ষণে জানাচ্ছে, দুর্ঘটনার সময় দেখে ধারণা করা হচ্ছে, ইরান বিমানটিকে ভুল করে মার্কিন যুদ্ধবিমান ভেবেছিল।
সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, দুটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর একটি বিস্ফোরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া সংবাদমাধ্যম নিউজউইক মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, ইউক্রেনের বিমানটি রাশিয়া নির্মিত ‘টর’ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বৃহস্পতিবার বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে তাঁর ‘সন্দেহ’ প্রকাশ করেন।
তেহরানে বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে ট্রাম্প কী মনে করছেন—জানতে চাইলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মনে কিছু বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। যা হয়েছে, তা খুবই মর্মান্তিক। তবে কেউ হয়তো কোনো ভুল করে থাকতে পারে।’
ইরাকের রাজধানী বাগদাদে সফররত ইরানের অন্যতম শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা কাসেম সোলেইমানিসহ আটজন গত ৩ জানুয়ারি একটি বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন রকেট হামলায় নিহত হন। এর পর থেকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিধ্বস্ত বিমান থেকে উদ্ধার করা ব্ল্যাকবক্স বিমানটির নির্মাণ সংস্থা বোয়িং কর্তৃপক্ষ বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করবে না বলে জানিয়েছিল ইরানের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। আর এতেই বিভিন্ন মহলে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
তবে এরপর ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুর্ঘটনার তদন্তে অংশ নিতে বোয়িং কর্তৃপক্ষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বৈশ্বিক বিমান বিধিমালা অনুযায়ী, এ দুর্ঘটনায় তদন্ত পরিচালনার অধিকার রয়েছে ইরানের। তবে সচরাচর এ ধরনের ঘটনায় বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও তদন্তে অংশ নিয়ে থাকে।
এদিকে ইরানি টেলিভিশনে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, বিমান বিধ্বস্তস্থলটি বুলডোজার দিয়ে সমান করে ফেলা হয়েছে।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের সচিব এক ফেসবুক পোস্টে জানান, বিমানটি দুর্ঘটনার পেছনে সম্ভাব্য তিনটি কারণ থাকতে পারে—এক, আকাশে ড্রোন বা অন্য কোনো উড়ন্ত বস্তুর সঙ্গে বিমানটির ধাক্কা লাগা; দুই, কারিগরি ত্রুটির কারণে ইঞ্জিন বিকল হওয়া কিংবা বিস্ফোরিত হওয়া এবং তিন, বিমানের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলার জেরে হওয়া কোনো বিস্ফোরণ। এরই মধ্যে ইরানে পৌঁছেছে ইউক্রেনের বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারী দল। এ দলে রয়েছেন ২০১৪ সালে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ‘এমএইচ১৭’ ফ্লাইট দুর্ঘটনার তদন্তকারী বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছিল ‘এমএইচ১৭’।
এদিকে দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে ইরানের বেসামরিক বিমান প্রতিষ্ঠান সিএওআইর প্রধান আলি আবেদজাদেহ বলেন, ‘কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের বিমানটিতে আঘাত করেনি। এ ধরনের গুজব অযৌক্তিক।’
ইরান সরকারের মুখপাত্র আলি রাবিয়েই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবরকে ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন।
আলি রাবিয়েই বলেন, ‘ওই বিমানে যেসব দেশের নাগরিক ছিলেন, সেসব দেশ ইরানে প্রতিনিধিদল পাঠাতে পারে। এবং আমরা বোয়িং কর্তৃপক্ষকে ব্ল্যাকবক্স তদন্তে যোগ দিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’
ইরান ইরাকে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টা পরই ইউক্রেন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের ওই বিমানটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তবে যান্ত্রিক কোনো ত্রুটির কারণেই সাড়ে তিন বছরের পুরোনো বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের ওই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন ইরানি কর্মকর্তারা।
গত মঙ্গলবার রাতে ইরানের রাজধানী তেহরানের পাশে ইউক্রেনের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আরোহীদের সবাই (যাত্রী, পাইলট ও ক্রু) নিহত হয়েছেন বলে ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলকে জানান দেশটির জরুরি বিভাগের কর্মকর্তা পির হোসেইন কুলিভান্দ।
ওই চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরানের খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর পরই যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।