ট্রাম্পের অভিশংসনে ভোটাভুটি আজ, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিশংসিত হবেন কি না, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদে ভোটাভুটি হবে আজ বুধবার রাতে। ভোটাভুটির আগে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে বাকবিতণ্ডা, উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য এবং ভোটাভুটি-পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে লড়াই।
ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ইউক্রেন বিষয়ে কংগ্রেসের কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার অভিযোগে আজ বুধবার ট্রাম্পের অভিশংসনের আওতায় আসা প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়।
আসছে বছর যুক্তরাষ্ট্রে হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দেশটি যখন সেদিকে এগোচ্ছে, ঠিক সে মুহূর্তে প্রেসিডেন্টের অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মার্কিন রাজনৈতিক বিভাজন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
ট্রাম্প-পেলোসি পাল্টাপাল্টি চিঠি
যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ বা কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের ওপর ভোটাভুটি হওয়ার ঠিক আগে নিম্নকক্ষের স্পিকারের কাছে কড়া ভাষায় চিঠি লিখেছেন ক্ষুব্ধ ট্রাম্প। ওই চিঠিতে ট্রাম্প অভিশংসন প্রক্রিয়ার তীব্র নিন্দা জানান এবং ‘যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা’ করার দায়ে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে অভিযুক্ত করেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল মঙ্গলবার পেলোসির কাছে ছয় পৃষ্ঠার একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে ট্রাম্প লেখেন, ‘আপনি অভিশংসন নামের নোংরা শব্দটির গুরুত্বকে সস্তা করে ফেলেছেন।’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও ইরানি সংবাদমাধ্যম পার্স টুডে এ খবর জানিয়েছে।
ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেন সরকারের ওপর বেআইনিভাবে চাপ প্রয়োগ করেছেন—এ অভিযোগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া চলছে। আজ বুধবার প্রতিনিধি পরিষদে এ সংক্রান্ত ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে।
মার্কিন কংগ্রেসের এই নিম্নকক্ষে ডেমোক্র্যাট দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এখানে অভিশংসনের প্রস্তাবটি পাস হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সেখানে ট্রাম্পের অভিশংসন আটকে যেতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিষয়টি মাথায় রেখে শুরু থেকেই তাঁকে অভিশংসন করার বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
এর আগে ট্রাম্প নিজে প্রতিনিধি পরিষদের অভিশংসন-সংক্রান্ত শুনানিতে অংশ নেননি এবং হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদেরও অংশ নিতে দেননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল মঙ্গলবার ন্যান্সি পেলোসিকে লেখা চিঠিতে দাবি করেন, ‘এই বানোয়াট অভিশংসনের শুরু থেকেই’ তাঁকে ‘যথাযথ সাংবিধানিক মৌলিক প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে’ এবং তাঁকে ‘প্রমাণ হাজির করার অধিকারসহ সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে’।
ট্রাম্প আরো লেখেন, ‘আমার কোনো সন্দেহ নেই, আসন্ন ২০২০ নির্বাচনে আমেরিকার জনগণ আপনাকে ও ডেমোক্র্যাটদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।’
‘তারা (মার্কিন জনগণ) ন্যায়বিচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করা আপনাদের সহসা ক্ষমা করবে না,’ যোগ করেন ট্রাম্প।
এরই মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পের অভিশংসন বিল নিয়ে আজকের ছয় ঘণ্টাব্যাপী বিতর্কের বিষয়টি অনুমোদন করেছে হাউস রুলস কমিটি।
বিতর্কের নিয়মকানুনও ভোটাভুটির মাধ্যমে ঠিক করা হয়েছে। জানা গেছে, বিতর্কের জন্য সমান সময় পাবে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা। বিতর্কে নেতৃত্ব দেবেন হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির নেতারা। ছয় ঘণ্টার বিতর্কের আগে ভোটাভুটির বিতর্কের রুল অনুমোদন নিয়ে হবে এক ঘণ্টার একপ্রস্থ বিতর্ক।
আগেই জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কংগ্রেসের কার্যক্রমে বাধা দেওয়া—অভিশংসনের এ দুটি অনুচ্ছেদ নিয়ে হবে ভোটাভুটি। এই ভোটাভুটির ফল সংশোধনযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে নিয়ম তৈরি করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হাউস কমিটি।
এদিকে, ট্রাম্পের চিঠিকে ‘অসুস্থ’ বলেছেন পেলোসি। পাল্টা একটি চিঠি লিখেছেন তিনিও। দলীয় সহকর্মীদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে ‘দেশি ও বিদেশি শত্রুর হাত থেকে সংবিধানকে রক্ষা ও সমর্থন’ দিতে সহকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন ডেমোক্রেটিক দল থেকে নির্বাচিত আইনপ্রণেতা ও হাউস স্পিকার পেলোসি।
প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসন সম্পর্কিত কার্যক্রম শুরু হবে বাংলাদেশ সময় আজ রাত ৮টায় (স্থানীয় সময় বুধবার সকাল ৯টায়)। ছয় ঘণ্টার অভিশংসন বিতর্কের অনুমোদন পাওয়া নিয়ে বিতর্ক দিয়ে শুরু হবে এ কার্যক্রম। অনুমোদন পাওয়ার পর শুরু হবে দীর্ঘ বিতর্ক। চূড়ান্ত ভোটাভুটি হবে স্থানীয় সময় বুধবার বিকেল বা সন্ধ্যা নাগাদ (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার ভোর)।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ
দীর্ঘ শুনানির পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের দুটি অভিযোগ সত্য বলে ঘোষণা দেয় প্রতিনিধি পরিষদের তদন্ত কমিটি। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ট্রাম্পকে অপসারণের প্রস্তাবের ওপর আজ বুধবার রাতে ভোট দেবেন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্যরা। তবে নিজের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ আগে থেকেই অস্বীকার করে আসছেন ট্রাম্প।
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে অভিশংসন অভিযোগের ওপরও ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ট্রাম্পকে অভিশংসনের পক্ষে ২৩টি ভোট পড়ে। আর বিপক্ষে ভোট দেন ১৭ জন। তদন্ত কমিটির রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সদস্যরা তাঁদের ভোট দেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানায়।
এর আগে বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় সেখানে ভোটাভুটিতে ট্রাম্পকে অভিশংসনের পক্ষেই রায় আসবে। তবে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানরা, তাই সেখানে ট্রাম্পই টিকে যাবেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসনে গত নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ ইস্যুর পর আলোচনায় এসেছে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ থাকা মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিতের বিষয়। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি দফায় দফায় শুনানি শেষে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে।
আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকির ওপর চাপ প্রয়োগ করে অভিশংসন তদন্তের মুখে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিষয়টির সত্যতা ও গভীরতা যাচাইয়ে সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। পাশাপাশি হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটিতে চলে সপ্তাহব্যাপী শুনানি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জো বাইডেন ও তাঁর ছেলে হান্টারের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে অভিযোগ আরোপ করার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকির ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। জানা গেছে, ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকিকে বলেন, তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত বাইডেন ও তাঁর ছেলের আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিত রাখা হবে। ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অনেক রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে বর্তমানে ট্রাম্পের বিরোধীরা সংখ্যাগুরু। ফলে প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পকে অভিশংসনের পক্ষে রায় এলে, অর্থাৎ ট্রাম্প অভিশংসিত হলে বিষয়টি যাবে কংগ্রেসের ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ সিনেটে। কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে সিনেটের দু-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হয়।
বর্তমান সিনেটে ৫৩ জন রিপাবলিকান, ৪৫ ডেমোক্র্যাটস ও দুজন স্বতন্ত্র সিনেটর রয়েছেন। স্বতন্ত্র দুই সিনেটর ডেমোক্র্যাট-ঘেঁষা। ট্রাম্পকে গদিছাড়া করতে সব ডেমোক্র্যাট সিনেটর ও দুই স্বতন্ত্র সিনেটরসহ অন্তত ২০ জন রিপাবলিকান সিনেটরের ভোট প্রয়োজন পড়বে।
অভিশংসিত যত মার্কিন প্রেসিডেন্ট
সর্বশেষ যে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তিনি বিল ক্লিনটন। ১৯৯৮ সালে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য প্রতিনিধি পরিষদে ভোটাভুটি হয়েছিল।
এর আগে ১৮৬৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু ক্লিনটন কিংবা জনসন, কেউই সিনেটে দোষী সাব্যস্ত হননি।
সুতরাং, অভিশংসনের অর্থ এই নয় যে এর প্রক্রিয়া শুরু হলেই কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে উল্লেখিত বিধান অনুযায়ী সিনেটের দু-তৃতীয়াংশ সিনেটরের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে ক্ষমতা হারাননি। এ পর্যন্ত দুজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হয়েছেন। ১৮৬৮ সালে অ্যান্ড্রু জনসন ও ১৯৯৮ সালে বিল ক্লিনটন অভিশংসিত হন। সিনেটে এক ভোটের জন্য মেলেনি অ্যান্ড্রু জনসনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে প্রয়োজনীয় দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হওয়ার আগেই ক্ষমতা ছাড়েন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন।