দুই মাথার যমজ বোন, জীবনের পথে পাত্তা পায়নি কোনো বাধা-বিপত্তি
অ্যাবি হেনসেল ও ব্রিটানি হেনসেল দুই বোন। এই হেনসেল বোনেরা প্রথম খবরের শিরোনাম হন ১৯৯৬ সালে। সে বছর ছোটপর্দার বিখ্যাত অনুষ্ঠান অপরাহ উইনফ্রে শো’তে আসে অতিথি হয়ে আসে যমজ এই দুই বোন।
অপরাহর সঙ্গে সে অনুষ্ঠানে জোড়ামাথার দুই বোনের হৃদয়স্পর্শী আলাপ মন ছুঁয়ে যায় দর্শকের। দুই বোন বর্ণনা করেন, বিরল যমজ হয়ে বেঁচে থাকার অনুভূতি।
অ্যাবি-ব্রিটানির পরিবারও জানায়, কত কষ্টের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে দুই বোন। এসব দেখে অনেকেই এই যমজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হন, জীবনটা অকালে থেমে যাবে না তো ওদের?
এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে জীবনের পথ পরিক্রমায় ঠিকই কিন্তু এগিয়ে গেছেন অ্যাবি ও ব্রিটানি।
এগিয়ে যাওয়ার পথে দুই বোনের ঝুলিতে জমেছে বেশকিছু অর্জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে গাড়িচালনার পরীক্ষায় উৎরানো—থেমে থাকেননি অ্যাবি-ব্রিটআনি।
অথচ চিকিৎসরাও ভাবতে পারেননি এত দিন বেঁচে থাকবেন এক দেহ দুই মাথার এই যমজ।
সংবাদমাধ্যম মিররের প্রতিবেদন বলছে, অ্যাবি-ব্রিটানির জন্ম ১৯৯০ সালে।
জন্মের আগে অ্যাবি-ব্রিটনির মা-বাবা প্যাটি ও মাইক হেনসেল জানতেন না তাঁদের ঘরে আসছে যমজ সন্তান। তাই অ্যাবি-ব্রিটানি যখন ভূমিষ্ঠ হলো, বেশ অবাকই হন হেনসেল দম্পতি।
কিন্তু মেয়েদের জন্মের পরই দুঃসংবাদ পান যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার বাসিন্দা প্যাটি ও মাইক। চিকিৎসরা জানান, তাদের মেয়েদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
আর যদি তারা বেঁচে থাকেও, জীবনটা তাদের কেমন হবে, তা নিয়ে চিকিৎসকরা বেশ চিন্তায় পড়ে যান।
পাঁচটি হাত নিয়ে জন্ম হয় অ্যাবি-ব্রিটানির। এর মধ্যে একটি হাত ছিল দুই মাথার মাঝখানে।
জন্মের কিছুদিন পরই ওই বাড়তি হাত কেটে বাদ দেন চিকিৎসকরা।
কিন্তু, ওই অস্ত্রোপচারের সাফল্যের পরও প্যাটি ও মাইক তাঁদের সন্তানদের শরীর আলাদা করতে ছুরি-কাঁচির মুখে ঠেলে দিতে নারাজ ছিলেন। কেননা ওই অস্ত্রোপচারে ছিল প্রাণের ঝুঁকি।
তাই সে ঝুঁকি না নিয়ে অ্যাবি-ব্রিটানির মা-বাবা সিদ্ধান্ত নেন, মেয়েদের জীবনকে উপভোগ করার সম্ভাব্য সব সুযোগ দেবেন তাঁরা।
মা-বাবার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন ২৯ বছর বয়সী অ্যাবি-ব্রিটানি।
নিজেদের ১৬তম জন্মদিনে গাড়িচালনার পরীক্ষা দেন দুই বোন। সফলভাবে সে পরীক্ষায় উৎরেও যান দুজন।
লাইসেন্স পাওয়ার পর ব্রিটানি ডেইলি মেইলকে বলে, ‘অ্যাবি পেডেল আর গিয়ার বদলানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম বাতির।’
‘অ্যাবি আমার চেয়ে জোরে গাড়ি চালাতে পছন্দ করে,’ যোগ করে ব্রিটানি।
তবে গাড়ি চালানোর পরীক্ষাটা মিলেমিশে দিলেও অ্যাবি-ব্রিটানি জানান, দুই বোনের রোজকার যাপিত জীবনে ব্যক্তিত্ব ও ধ্যান-ধারণায় রয়েছে বেশ স্বাতন্ত্র্যবোধ।
২০১২ সালে ডেইলি মিররকে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটানি বলে, ‘আমরা একদমই আলাদা দুজন মানুষ।’
অ্যাবি-ব্রিটানির স্বতন্ত্র্য জীবন যাপনের নজির মেলে তাঁদের শিক্ষাজীবনে। দুই বোন বেথেল ইউনিভার্সিটিতে পড়লেও, তাদের বিষয় ছিল ভিন্ন।
স্নাতক শেষে দুই বোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন।
সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে অ্যাবি বলেন, ‘বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা শুরু থেকেই জানতাম মাথা আমাদের দুটো হলেও বেতন আমরা একজনেরই পাব। কারণ কাজ তো আমরা করছি একজনের।’
‘পাঠদানের সময় আমরা অবশ্য নিজেদের মধ্যে একটু বোঝাপড়া করে নিই। কারণ আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন কিংবা আমাদের পড়ানোর ধরনটাও আলাদা,’ যোগ করেন অ্যাবি।
একসঙ্গে কাজ করার কিছু সুবিধাও রয়েছে, স্বীকার করেন ব্রিটানি।
ব্রিটানি বলেন, ‘একজন পড়াতে থাকলে অন্যজন ক্লাসের ওপর নজর রাখতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে।’
‘সে হিসেবে আমরা একজনের চেয়ে বেশি কাজ করতে সক্ষম,’ যোগ করেন ব্রিটানি।
যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুবোন পড়ান, সেখানকার প্রধান শিক্ষক পল গুড জানান, শিশুদের কাছে এই জমজ বোনেরা রীতিমতো দৃষ্টান্তস্বরূপ।
পল গুড বলেন, ‘আমি মনে করি, ওরা যদি কোনো কিছু করতে চায়, সেটা না করতে পারার কারণই নেই।’
‘শিশুদের জন্য এই বার্তাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যেসব শিশু হয়তো একটু পিছিয়ে পড়েছে, তাদের জন্য অ্যাবি-ব্রিটানি দৃষ্টান্তমূলক জীবন্ত উদাহরণ।’