মালদ্বীপকে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

Looks like you've blocked notifications!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বৃহস্পতিবার মালদ্বীপের জাতীয় সংসদে ভাষণ দেন। ছবি : ফোকাস বাংলা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মালদ্বীপের জাতীয় সংসদে ভাষণ দেওয়ার সময় মালদ্বীপের সরকারি ও বেসরকারি খাতকে পারস্পরিক সুবিধার জন্য বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশ একা উন্নতি করতে পারে না। আমি আশা করি, আমাদের উষ্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুসংহত হবে। বাংলাদেশ সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি মালদ্বীপের সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধার জন্য আগামী ৫০ বছরে উন্নয়ন যাত্রায় আমাদের অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানাই।’

বিশ্বের কোনো দেশ বিচ্ছিন্নভাবে উন্নতি করতে পারে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি সবাইকে শিখিয়েছে যে তারা পরস্পর নির্ভরশীল এবং একটি উন্নত, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ বিশ্বের স্বার্থে তাদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতিগত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি, যেমনটি আমাদের জাতির পিতা বলে গেছেন।’

মালদ্বীপের জাতীয় সংসদ ‘পিপলস মজলিস’-এ বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর আগমনে স্পিকার মোহাম্মদ নাশিদ এবং ডেপুটি স্পিকার তাঁকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী পরে দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন এবং মালদ্বীপের সংসদের স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক করেন।

মালদ্বীপের পার্লামেন্টের স্পিকার তাঁর বক্তৃতায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশের নেতৃত্বদানে শেখ হাসিনার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ইস্যুগুলোতে সম্মত করাতে শেখ হাসিনাকে পাঁচ চুক্তি প্রণেতার অন্যতম হিসেবে বিবিসি রিপোর্টের কথাও উল্লেখ করেন। স্পিকার প্রধানমন্ত্রীকে একটি নৌকার চিত্র শিল্পকর্ম উপহার দেন।

সংসদের ভাষণে শেখ হাসিনা আরও বলেন, এই সুন্দর দেশের গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র, রাজনীতি ও নীতির এই আবাসস্থলে মজলিসের বিশিষ্ট সদস্যদের মাঝে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি গভীরভাবে সম্মানিত।

সারাজীবন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন এক ব্যক্তি হিসেবে মালদ্বীপের মজলিসে উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ জানিয়ে বলেন, ‘আমি এখানে একটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সংসদে উপস্থিত হতে পেরে আনন্দিত, যার সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক যোগসূত্র, বহুবিধ মিল, একই ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সমৃদ্ধির একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করে থাকি।’

২০২১ সালটি বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি যুগান্তকারী বছর উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যেখানে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে ফলপ্রসূ দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আশা করেন, দুই দেশের আগামী ৫০ বছরের যাত্রা আরও ফলপ্রসূ হবে এবং জনগণের জীবনে অর্থবহ পরিবর্তন আনবে। তিনি বলেন, ‘আমি মালদ্বীপের জনগণ এবং এর অগ্রগামী নেতাদের জন্য সুখ এবং সমৃদ্ধি কামনা করছি।’

প্রধানমন্ত্রী ভাষণে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। যিনি তাঁর সারাটি জীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত শোষণ, বঞ্চনাহীন সমাজ বিনির্মাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী গত মার্চে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগদান করায় মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহকে ধন্যবাদ জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ সহজ ছিল না। জাতির পিতা বাংলার মানুষের সুখের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১৩ বছর জেলে কাটিয়েছেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে আসার পর তাঁর জনগণের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন ও পুননির্মাণ শুরু করে সাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সদ্যজাত দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত করেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জাতির পিতাকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি এবং আমার ছোট বোন (শেখ রেহানা) সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই এবং পরবর্তীতে ছয় বছর প্রবাসজীবনে থাকতে বাধ্য হই। বাংলাদেশে ফিরে এসেও কারাবাস, একাধিক গুপ্তহত্যার চেষ্টা এবং অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, যাই হোক, এটা আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি যে আজ বাংলাদেশ গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশংসা অর্জন করেছে।’ 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশের আর্থ-সামাজিক মুক্তির পথের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং এই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, আমি ভাগ করে নিতে পেরে আনন্দিত যে- বাংলাদেশ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আগের কয়েক বছরে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের বেশি ছিল, মহামারির ঠিক আগে, আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল আট দশমিক দুই শতাংশ।’

গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ এবং শিশুর স্বাস্থ্য, আয়ুষ্কাল, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, স্যানিটেশন, পানীয় জল, প্রাথমিক শিক্ষা এবং সাক্ষরতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের উন্নয়ন যাত্রার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবার পর এখন লক্ষ্য হচ্ছে- ২০৩১ সালের মধ্যে এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে পরিণত করা এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ এবং স্থিতিস্থাপক ডেল্টায় পরিণত করা। তিনি বলেন, আপনারা হয়তো অবগত আছেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৪ নভেম্বর ২০২১ তারিখে বাংলাদেশের এলডিসি বিভাগ থেকে উন্নয়মশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ৪১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এবং বিশ্বের ৩৪টি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।’

উন্নয়ন তার নিজস্ব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এলডিসি হিসাবে আমরা যে সুবিধাগুলি উপভোগ করতাম তা প্রত্যাহারের পরে আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হব তা মোকাবেলা করার জন্য, আমাদের ফোকাস হবে অর্থনীতির বৈচিত্রকরণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের দিকে। তিনি বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে একটি প্রযুক্তি-চালিত সমাজ এবং উদ্ভাবন-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধিতে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’