যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভকে নির্বাচনী হাতিয়ার করছেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিসে গত সপ্তাহে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাঁটুর চাপে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে টালমাটাল হয়ে পড়েছে সারা দেশ। উনিশশো আটশট্টি সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের হত্যাকাণ্ডের পর এত বড় সহিংস বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রে আগে হয়নি।
প্রায় ৪০টি বড় বড় শহরে সন্ধ্যার পর থেকে কারফিউ চলছে। এ ছাড়া ২২টি অঙ্গরাজ্যে ন্যাশনাল গার্ড অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় রিজার্ভ সেনাবাহিনীর ১৭ হাজারেরও বেশি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসের কাছে গত শুক্রবার থেকে বিক্ষোভের মাত্রা যেভাবে বাড়ছিল, তাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উদ্বিগ্ন দেহরক্ষীরা কিছুক্ষণের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মাটির নিচে একটি বাঙ্কারে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এ সংকটের মধ্যেই এক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প যেসব টুইট করছেন, এবং বিশেষ করে গত সোমবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউসে যে ভাষণ তিনি দিয়েছেন, তাতে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক নিশ্চিত যে বর্ণবাদবিরোধী এ বিক্ষোভকে ট্রাম্প আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে জেতার প্রধান হাতিয়ার করতে চাইছেন।
হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনের লনে সংক্ষিপ্ত এক বিবৃতিতে ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত শহর ও গভর্নরদের একহাত নিয়েছেন। তিনি হুঁশিয়ার করেছেন, তাঁরা যদি ‘সাধারণ মানুষের জানমাল এবং সম্পদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি সেনা মোতায়েন করে নিজেই ‘তাঁদের হয়ে সমস্যার সমাধান করে দেবেন।’
কয়েকশ বছরের পুরোনো যে আইনের ভিত্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেনা মোতায়েনের কথা বলছেন, তার জন্য গভর্নরদের কাছ থেকে অনুরোধ আসতে হয় এবং পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে হয়।
শেষবার এ আইন কার্যকর করে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল ১৯৯২ সালে, লস অ্যাঞ্জেলেসে পুলিশের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভ থামাতে।
তাঁর ভাষণে ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, চলতি বিক্ষোভের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক কম, বরং কট্টর বামপন্থীরা প্রতিবাদের নামে বিশৃঙ্খলা ও লুটপাট করছে। ট্রাম্প বলেন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগঠন ‘অ্যান্টিফা’ কে তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় ঢোকাবেন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনা মোতায়েন করতে পারুন আর নাই পারুন, ট্রাম্প দেখাতে চাইছেন ডেমোক্র্যাটরা অথর্ব, তারা মানুষের জানমাল রক্ষা করতে পারে না। ফলে তিনিই একমাত্র ত্রাতা, তাঁর কোনো বিকল্প নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক এবং গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো ড. আলী রিয়াজ বলছেন, গত সোমবার হোয়াইট হাউসের লনে ট্রাম্পের বিবৃতির প্রধান টার্গেট ছিল ভোটাররা।
ড. আলী রিয়াজ বলেন, “তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল — এক, ট্রাম্প নিজেকে ‘আইন-শৃঙ্খলার প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দুই, বক্তব্য শেষ করে তিনি বিক্ষোভে ক্ষতিগ্রস্ত একটি গির্জার কাছে গিয়ে বাইবেল হাতে ছবি তুলেছেন, যার লক্ষ্য রক্ষণশীল খ্রিস্টান ভোটার গোষ্ঠী। তিন, তিনি সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ডের প্রসঙ্গ টেনেছেন, যেটা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী এবং ঘরে বন্দুক রাখার পক্ষের মানুষজনের মনের কথা।”
ওয়াশিংটন থেকে বিবিসির সাংবাদিক অ্যান্থনি জারকারও বলছেন, বিক্ষোভ শুরুর সাতদিন পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘এ অসন্তোষের মূল কারণ বা পুলিশের সংস্কার নিয়ে টুঁ শব্দও করেননি। বরং ট্রাম্প নিজেকে এমন একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাণ্ডারি।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও তার সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করেছেন। নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র ও ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি টুইট করেছেন, ‘তাকিয়ে দেখুন যেসব শহরে শত শত মিলিয়ন ডলারের সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, সহিংসতা হচ্ছে, সবগুলোর নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্র্যাটদের হাতে। ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে আপনাদের এই পরিণতিই হবে।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসের হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা পিটার বেকার বলছেন, সংকট নিয়ে একটি ঐকমত্য তৈরির চেষ্টার বদলে প্রেসিডেন্ট মেরুকরণের চেষ্টায় নেমে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘পুরো সংকটকে একটি রাজনৈতিক বিভাজন হিসেবে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছেন তিনি... একজন নেতা হিসেবে তাঁর যে মৌলিক চরিত্র, তা আরেকবার স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।’
নির্বাচনের বছরে নভেল করোনাভাইরাস সামাল দেওয়া নিয়ে তাঁর নিজের ও তাঁর প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রচণ্ড চাপে রয়েছেন ট্রাম্প। এখন পর্যন্ত যে ৪০টির মত জনমত জরিপ হয়েছে, তার সবগুলোতেই তিনি সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে।
আগামী নভেম্বরের নির্বাচন যেন নভেল করোনাভাইরাসের ওপর একটা গণভোটে না হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে তাঁর বুদ্ধিদাতারা মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন। যখনই ট্রাম্প চাপের মধ্যে পড়েন, তখনই তিনি কল্পিত একটি শত্রু খাড়া করে হম্বিতম্বি, দোষারোপ শুরু করে দেন। চলতি বিক্ষোভেও ট্রাম্প একইরকম আচরণ শুরু করেছেন। তিনি বলার চেষ্টা করছেন, সব সমস্যার মূল কারণ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।
আসলে নির্বাচনের বছরে গত পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলে গেছে, তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছয় মাস আগে কল্পনাও করতে পারেননি।
ড. আলী রিয়াজ বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আশা ছিল স্থিতিশীল অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে সহজে তিনি জিতে যাবেন, কিন্তু করোনাভাইরাস সংকটে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। কয়েক মাসের মধ্যে চার কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে।
‘সুতরাং মূল্যবোধ-সংস্কৃতির ভিত্তিতে সমাজে একটি বিভক্তি তৈরি করে, তাঁর সমর্থকদের একাট্টা করা ছাড়া কোনো রাস্তা ট্রাম্পের কাছে এখন নেই।’
বর্ণবাদবিরোধী সহিংস বিক্ষোভ ট্রাম্পকে সে সুযোগ এনে দিয়েছে সন্দেহ নেই।
কিন্তু ট্রাম্পের এ কৌশল কাজে দেবে কি না, তা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। যদিও এমন উদাহরণ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে।
উনিশশো আটশট্টি সালে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে রিচার্ড নিক্সনের প্রধান স্লোগান ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। সে নির্বাচনে জিতেছিলেন তিনি।
ড. রিয়াজ বলছেন, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের পেছনে হয়তো গতবারের চেয়ে শক্তভাবে দাঁড়াবে, কিন্তু ‘ডেমোক্র্যাটদের একটি সরু সুতোর ওপর হাঁটতে হবে’। তাদের দেখাতে হবে, তারা আইন-শৃঙ্খলার পক্ষে, সহিংসতার বিপক্ষে আবার একই সঙ্গে নাগরিক অধিকারের পক্ষে এবং বৈষম্যের বিরোধী। রিপাবলিকানরা আশা করছে এ ভারসাম্য রক্ষা করা ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে কঠিন হবে’।