দাঙ্গা-হামলার জেরে দ. আফ্রিকা ছাড়ছেন শত শত প্রবাসী
দক্ষিণ আফ্রিকায় চলমান প্রাণঘাতী জেনোফোবিক (বিদেশিদের সম্বন্ধে অহেতুক ভয় বা ঘৃণা) হামলার জেরে দেশটি থেকে ছয়শর বেশি নাগরিককে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে নাইজেরিয়া। জেনোফোবিক হামলার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পর্কে দারুণ টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।
নাইজেরিয়ার বেসরকারি বিমান সংস্থা এয়ার পিস স্বেচ্ছায় উদ্যোগী হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত প্রবাসী নাইজেরীয়দের গতকাল বুধবার দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী লাগোসে নিয়ে আসে। সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ১৮৯ প্রবাসী নাইজেরীয় ব্যবসায়ীকে লাগোসে নিয়ে আসে এয়ার পিসের একটি ফ্লাইট। এসব প্রবাসী নাইজেরীয়র দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফ্লাইটে ওঠার পর এসব নাইজেরীয়র কাউকে বাতাসে ঘুসি মেরে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। আবার কাউকে নিজেদের পুড়ে যাওয়া দোকানের ছবি দেখিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে দেখা যায়।
দুই বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় কাপড়ের ব্যবসা করছিলেন স্যামসন আলিউ। বার্তা সংস্থা এএফপিকে স্যামসন বলেন, ‘জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছি, না হলে ওরা আমাকে মেরে ফেলত। আমার দোকানসহ সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা।’
আজ বৃহস্পতিবার বা আগামীকাল শুক্রবার আরো নাইজেরীয় নাগরিক দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়ছেন। মোট ৬৪০ প্রবাসী নাইজেরীয় দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে পালাচ্ছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া ও জোহানেসবার্গে বসবাসরত এক হাজার প্রবাসী ব্যবসায়ীকে হামলার টার্গেট করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে উদ্ভূত দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত ১২ প্রবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত প্রবাসীদের পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো না হলেও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, তাঁরা নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, কঙ্গো ও জিম্বাবুয়ের নাগরিক।
দক্ষিণ আফ্রিকার জেনোফোবিক সংঘাত নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্জন করার দাবিও উঠেছে।
দুই দশক ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় সপরিবারে বসবাস করছিলেন ধর্মপ্রচারক উগো ওফোয়েগবু। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নাইজেরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।
সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে উগো ওফোয়েগবু বলেন, ‘পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আমি শঙ্কিত। আমার পরিবার এখানে নিরাপদ নয়।’
জোহানেসবার্গের উপকণ্ঠে বসবাসরত ৩৫ বছর বয়সী নারী ওলুচি এম্বাবির অবস্থা আরো শোচনীয়। পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার ও দর্জি ওলুচিকে তিন সন্তানসহ দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে পালাতে হচ্ছে। স্বামীকে রেখেই নাইজেরিয়া চলে যেতে হচ্ছে তাঁকে।
জোহানেসবার্গের রোসেটেনভিল এলাকায় থাকতেন এম্বাবি। এই রোসেটেনভিলেই সবার আগে সংঘাত বাধে। এম্বাবি বলেন, ‘আমি আর আমার স্বামী সিদ্ধান্ত নিয়েছি সন্তানদের নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো হবে।’
এম্বাবি বলেন, ‘আমরা যেখানে থাকতাম, জেনোফোবিয়ার কারণে সেখানকার পরিস্থিতি প্রচণ্ড বিপজ্জনক। ওরা বলছে, সেখানে কোনো বিদেশিকে তারা থাকতে দেবে না।’
উদ্ভূত পরিস্থিতির পাল্টা জবাব হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে নাইজেরিয়া গত সপ্তাহে বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে লাগোসে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কেবল নাইজেরীয়রাই ক্ষতিগ্রস্ত নন
সংঘাত শুরু হওয়ার পর মালাবি ও জিম্বাবুয়েসহ বিভিন্ন দেশের সাতশর বেশি প্রবাসী তাঁদের বাসা ছেড়ে কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের বেশিরভাগই বাসা থেকে বেশি মালামাল নিয়ে আসতে পারেননি।
সতর্ক রয়েছে পুলিশ
দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদেশিদের ওপর হামলার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিকসহ অন্তত ৬২ জনকে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালে প্রবাসীদের মালিকানাধীন দোকানপাট লুট করা হয়। এ সময় প্রবাসীদের ওপর চালানো হামলায় সাতজন নিহত হন।
সাম্প্রতিক সংঘাতের মূল কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বেকারত্বের উচ্চহার, দারিদ্র্য ও অপরাধ প্রবণতা এবারের সংঘাতের জন্য দায়ী।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এসব হামলা ও সংঘাতকে জেনোফোবিক হামলা বলতে নারাজ। সরকারের ভাষ্য, এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী নসিভিয়ে মাপিসা-নাকাকুলা বলেন, ‘যদিও (হামলা ও সংঘর্ষের) ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে এসেছে, তবু সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে আর কোনো সংঘর্ষের ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।’
এ ছাড়া পুলিশমন্ত্রী ভেকি চেলে জানান, এখন পর্যন্ত ৬৫৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে কিছু বিদেশিসহ বেশিরভাগই দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক।
সাম্প্রতিক সংঘাত বিষয়ে আলোচনাসহ বিষয়টি সমাধানের পথ খুঁজতে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি আগামী মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করবেন বলে জানা গেছে।