বিস্ময়কর কসরত আর কুংফুর জন্মস্থানের গল্প
চীনের বিশেষ শারীরিক কসরত কুংফু সম্পর্কে যাঁরা সামান্য খোঁজখবরও রাখেন, তাঁদের কাছে ‘শাওলিন টেম্পল’ নামটি নিশ্চয়ই খুব চেনা। অথবা আপনি যদি চলচ্চিত্রানুরাগী হন, কী করে ভুলবেন জ্যাকি চ্যানের প্রথম হলিউড চলচ্চিত্র ‘শাওলিন টেম্পল’-এর কথা।
এবার হেনান প্রদেশের উঁচু ও খাড়া পাহাড় সংশানের প্রান্তে ভিক্ষুদের কংফু কসরতের এমন কিছু ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যা দেখলে ভয়েই হয়তো অনেকের চুল খাড়া হয়ে যাবে।
এই হেনান প্রদেশে অবস্থিত অন্যরকম উপাসনালয় ‘শাওলিন টেম্পল।
শাওলিন টেম্পলকে ঘিরে পৃথিবীজুড়ে অনেক কিংবদন্তি আর রহস্য চালু আছে। বিস্ময়কর মার্শাল আর্ট তথা কুংফুশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশ এই শাওলিন টেম্পলকে ঘিরেই। সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের মতে, এটিই চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির। শুধুমাত্র দীর্ঘ ইতিহাস আর বুদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যই এটি বিখ্যাত নয়। এর সবচেয়ে বড় খ্যাতি মার্শাল আর্ট ও কুংফুর জন্য।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, শাওলিন টেম্পলের এই বিশেষ শারীরিক কসরত চর্চা ভারতীয় সন্ত বোধিধর্মের হাত ধরে আসে। কথিত আছে, বোধিধর্ম চতুর্থ শতকের শুরুতে ভারত থেকে চীনে এসেছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য।
শাওলিনে এসে তিনি খোঁজ পান ‘জেন’ মতাবলম্বীদের। যাদের বিশ্বাস ছিল যে নিবিড় তপস্যা এবং আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে বোধি বা নির্বাণ লাভ করা যায়। তারা জোর দিয়েছিলেন নিজের অন্তরের খোঁজ করা এবং একাকী তপস্যার ওপর। বোধিধর্মও এই মতে উপাসনালয়ের ওপরের পাহাড়ের নির্জন এক গুহায় দীর্ঘ নয় বছর নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তপস্যায়। বলা হয়, সেই সময়ে তার ছায়া নাকি গুহার দেয়ালের গায়ে বসে গিয়েছিল চিরস্থায়ীভাবে। সেই ছায়া খোদাই করা প্রস্তর খণ্ডটি শাওলিন টেম্পলে সংরক্ষিত আছে আজও।
কুংফুর কৌশল আর ভঙ্গিগুলো ধার করা হয়েছে বিভিন্ন জীবজন্তুর আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার নানা ভঙ্গিমা থেকে। বাঘ, ঈগল, সাপ, ভালুক, ড্রাগন ইত্যাদি নানা জীবজন্তু কীভাবে কোন পদ্ধতিতে আক্রমণ করে, মুহূর্তের মধ্যে সরে যায় শত্রুর নাগালের বাইরে, কীভাবেই বা ছোটে বিদ্যুৎগতিতে এসব কিছু পর্যবেক্ষণ করে তার ধারণাগুলো নিয়ে আসা হয়েছে কুংফুতে।
কুংফু নিয়ে বোধিধর্মের শাওলিন টেম্পলের দেয়ালে খোদাই করা আছে বোধিধর্মের একটি কথা, ‘আত্মরক্ষা কর কুমারী মেয়ের মতো, আর আক্রমণ কর বাঘের মতো’ অর্থাৎ লড়াইয়ে সাহসের পাশাপাশি সতর্কও হতে হয়, না হলে বিপদ অনিবার্য।
শাওলিন টেম্পলে কুংফু শিখতে আসা শিক্ষার্থীদের সন্ন্যাসী বলা হয়। কিন্তু কুংফুর মতো বিপজ্জনক লড়াইয়ে সিদ্ধহস্ত হতে যারা প্রশিক্ষিত হয়, তারা কেমন করে সন্ন্যাসী হন? অবাক করার মতো বিষয় হলেও ইতিহাস তাই বলে। আজ থেকে দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে এই অঞ্চলে সূচনা হয় ‘জেন’ নামক বৌদ্ধধর্মের একটি ধারার। একই সঙ্গে কুংফুরও যাত্রা শুরু হয়।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ‘জেন’ আর ‘কুংফু’ চলে গেছে দুই পথে। কিন্তু শাওলিন টেম্পলের সন্ন্যাসীরা ‘জেন’ আর ‘কুংফু’ এই দুই জীবনাদর্শকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন তাঁদের জীবনে। তাই ধর্মের স্থিরতা আর মানসিক দৃঢ়তা তাঁদের করেছে শান্ত, সৌম্য। পাশাপাশি কুংফুর কলাকৌশল তাদের করছে ক্ষিপ্র ও শক্তিশালী। আর এ কারণেই শাওলিন টেম্পলের অধিবাসীদের ‘যোদ্ধা সন্ন্যাসী’ বলে অভিহিত করা হয়।
বছর তিরিশেক আগেও শাওলিন টেম্পলের কার্যক্রম বাইরের পৃথিবীর কাছে ছিল অনেকটাই অজানা আর রহস্যময়। শাওলিন টেম্পল তখনো ছিল সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরবর্তীকালে কুংফুবিষয়ক চলচ্চিত্র আর শাওলিন সন্ন্যাসীদের নানা প্রদর্শনীর মাধ্যমে শাওলিন টেম্পলের নাম দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য শাওলিন টেম্পল হয়ে ওঠে জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র।
এই টেম্পলের কার্যক্রম শুরু হয় খুব ভোরে। প্রথমেই দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যান চর্চা করেন সন্ন্যাসীরা। ধ্যান শেষে শুরু হয় কুংফু প্রশিক্ষণ। দীর্ঘক্ষণ কুংফু প্রশিক্ষণ শেষে পাঠ করা হয় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এরপর আরম্ভ হয় জাগতিক কাজ। বেঁচে থাকার জন্য রুটি-রুজিও তো করতে হবে। এ জন্য শাওলিন সন্ন্যাসীরা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নানা শারীরিক কসরত প্রদর্শন করেন।
এ ছাড়া শাওলিন টেম্পল-বিষয়ক নানা রকম স্যুভেনির বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এ ধরনের জাগতিক কাজে সন্ন্যাসীরা মন থেকে সায় পান না ঠিকই; কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য এসব অপ্রিয় কাজগুলোও ভীষণ নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের সঙ্গে সম্পন্ন করেন তাঁরা।
প্রতিবছর হাজার হাজার কম বয়সী ছেলে শাওলিন টেম্পলে এসে হাজির হয় কুংফু শেখার জন্য। আগ্রহী এই শিশু-কিশোর-তরুণদের জন্য উপাসনালয়ের চারপাশে স্থাপন করা হয়েছে ২০টি স্কুল।
নাম স্কুল হলেও এখানে পড়াশোনা করা মোটেও সহজ নয়। একবার ভর্তি হয়ে গেলে দেখা যাবে অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু, ধৈর্য, নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় ছাড়া ওখান থেকে শেখা যায় না কিছুই। কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। সপ্তাহে একদিন ছুটি, বাকি ছয়দিনই চলে কঠিন প্রশিক্ষণ।
প্রতিদিন চারটি সেশনে ভাগ করা সময়ে সারাক্ষণই কঠোর শিক্ষণ। কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে অন্য সব কাজই অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজেকেই করতে হয়। খাবার পরিবেশন করা হয় উপাসনালয়ের সামনে খোলা জায়গায়। এমনকি যখন বরফ পড়ে, হাড় কনকনে ঠান্ডাতেও বাইরে বসেই খেতে হয়।
রাতে শোয়ার জন্য রয়েছে লম্বা হলঘর। সেখানে শিক্ষার্থীরা পাশাপাশি শুয়ে অঘোরে ঘুমায়। সারা দিন পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চায় শরীর, বিছানাই পিঠ ঠেকা মাত্রই দুই চোখ বুজে আসে নিজেরই অজান্তে।
এই কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাঝে বিনোদনের জন্য সময় বরাদ্দ রয়েছে সপ্তাহের একটি দিনের ঘণ্টা কয়েক। ওই দিন খোলা জায়গায় প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটি সিনেমা দেখানোর আয়োজন করা হয়।
বেশির ভাগ সময়ই সিনেমাগুলো হয় কুংফু-বিষয়ক। সারাটা সপ্তাহ কঠিন নিয়মের মধ্যে কাটানো প্রশিক্ষণার্থীরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে এই কয়টা ঘণ্টার জন্য। মুগ্ধ চোখে সবাই তাকিয়ে থাকে সিনেমার ঝলমলে জীবনের দিকে। হয়তো কল্পনায় নিজেকে ভেবে নেয় সিনেমার ওই দুর্ধর্ষ কুংফুর দক্ষ নায়কের জায়গায়।
তবে কুংফুর পাশাপাশি চীনের ভাষা অর্থাৎ ম্যান্ডারিন এবং অঙ্কও শিখতে হয় এখানকার প্রশিক্ষণার্থীদের। তবে মূল মনোযোগ এবং একাগ্রতা থাকে একদিকেই কেন্দ্রীভূত। আর সেই দিকটি হচ্ছে এক এবং অদ্বিতীয় কুংফু।