খাদের কিনারে বাংলাদেশ
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/03/27/photo-1427473794.jpg)
বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকেই ঢাকায় অস্থিরতা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা ব্যালট বাক্স থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে থমকে পড়েছে অর্থনীতি ও দুর্বল হয়েছে সরকার।
জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে শুরু হওয়া বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে নিহত হয়েছেন ১০০-এর বেশি মানুষ। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বারবার সংকট দেখা গেছে। এ কারণে হয়েছে সামরিক হস্তক্ষেপ, হত্যার শিকার হয়েছেন উচ্চ পর্যায়ের অনেক রাজনীতিবিদ এবং দেখা দিয়েছে অকার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে দুটি রাজনৈতিক দলই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আসে। সবকিছুর ওপরে ‘বেগম’ হিসেবে পরিচিত দুই নেত্রীকে কেন্দ্র করেই রাজনীতি, একজন হলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অপরজন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া। প্রথমজন হলেন দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, আর দ্বিতীয়জন দেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, যিনি দেশের রক্ষণশীল সমাজের কাছে জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের দলগুলোর রাজনীতিবিদ ও তাঁদের গঠিত সরকার দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বর্তমান অস্থিরতার শুরু হয় ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন দিয়ে, যা বয়কট করেছিল বিরোধী দল। এ কারণে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিরোধী দল হিসেবে উল্লেখ্য, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দাবি ছিল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। হাসিনা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং একপেশে নির্বাচনে যান, যা পরিষ্কারভাবে তাঁকেই আরেকবারের জন্য ক্ষমতায় আনে।
নির্বাচন থেকে অস্থিরতায়
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে, বিরোধীরা দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ ঘোষণা করে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয়। বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে এবং বিরোধী দলের কর্মীদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সরকার শক্ত হাতে এটি দমন করে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দল অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবরোধের ডাক দেয়। বিরোধী দলের কর্মসূচি আর এর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থান চলতেই থাকে এবং অনেকগুলো ভয়াবহ সংঘর্ষের রূপ নেয়। সরকার দুই সপ্তাহের মতো খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং তাঁর বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতি মামলাগুলো গতি পায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সহায়তার অভিযোগে বিচারের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর ওপর চাপ অব্যাহত আছে। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। অগ্নিসংযোগ ও বাসে বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন ১০০-এর বেশি মানুষ। আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের ২০ সমর্থক।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ বেশ উদ্বিগ্ন। সর্বশেষ এমন রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা গেছে ২০০৭ সালে, যখন সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে।
রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক নূরুল আমিন বলেন, দুই দলেরই কট্টরপন্থীরা মনে করেন, কোনো ছাড় অসম্ভব।
ভালো সরকার ব্যবস্থায় আগ্রহীদের মতে, দুই দলই মধ্যযুগীয় শাসকের মতো আচরণ করছে, তারা দেশকে দুটি ভাগে বিভক্ত করছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, বিরোধী দলের কিছু মানুষের ভয়াবহ অপরাধ, সরকারের হত্যা, আহত করা বা ভুলভাবে গ্রেপ্তারকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করে না।
অর্থনৈতিক ও সরকারি সমস্যা
রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থায় অবরোধ, শহরের অনুন্নত অঞ্চলের সংঘাত, দেশের অনিশ্চয়তার কারণে ভিত নড়ে গেছে দেশের অর্থনীতি। সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাতটি এসেছে দুই হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক খাতে। এই শিল্পের সরবরাহ প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শিল্পমালিকদের সংগঠন এফবিসিসিআই জানিয়েছে, এরই মধ্যে ৩৯০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া খুচরা বিক্রয় খাতে ক্ষতি আরো ২১০ কোটি মার্কিন ডলার। কৃষি খাতে ক্ষতি ৫৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। আর কৃষিতে উৎপন্ন অনেক ফসল শহরে বিক্রি করতে না পারায় তা পচে নষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কিছু অংশ হারিয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক কিছুটা নিচে নেমেছে।
বিরোধী দলের অভিযোগ, বিচারব্যবস্থা ছয় বছর ধরে আওয়ামী লীগের কুক্ষিগত। প্রকৃত সত্যটি হলো, রাষ্ট্রযন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে দুই দলই নিজেদের মানুষ ঢুকিয়েছে, যে কারণে এসব স্থানেও বিভক্তি দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন নতুন কোনো পদ্ধতি। বর্তমান সরকার সংবিধান থেকে আগের ম্যান্ডেট তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দিয়েছে।
পরবর্তীকালে কী হবে?
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংঘাতের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতি অহংকারী দুই নেতৃত্ব ও তাঁদের সমর্থকদের কাছে জিম্মি। অপর গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, সামরিক বাহিনী কোনো হস্তক্ষেপ না করে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। হাসিনার প্রথম আমলে সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষতা আনা হয় এবং ওই সময়েই সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা নিহত হন (বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায়)।
বাংলাদেশের রাজনৈতি সংঘাত একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। তবে সাধারণত এটি ঘটে নির্বাচনের আগে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি এই রেখা অতিক্রম করেছে। এটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই হুমকির মুখে ফেলেছে। শেখ হাসিনা সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, খালেদা জিয়া সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আসতে চায়। কিন্তু সামরিক হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। অপরদিকে, বিরোধী দলের অভিযোগ হাসিনা সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখতে কৌশল অবলম্বন করেছে। সরকারে সামনে একমাত্র পথ রাজনৈতিক আলোচনা শুরু করা এবং একটি সমঝোতায় আসা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অন্যতম মিত্র ভারতের উচিত ঢাকাকে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে উদ্বুদ্ধ করা। তা না হলে ২০০৬ সালের মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের অন্যতম সহযোগী ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও উচিত ঢাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নেওয়া।এসব উদ্যোগ নেওয়া না হলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা চলতেই থাকবে।