ভূমিকম্পে অক্ষত ‘কুমারী দেবী’ আর তাঁর বাসস্থান

Looks like you've blocked notifications!
নেপালের ১০ বছর বয়সী কুমারী দেবী। ছবি: রয়টার্স

নেপালে গত সপ্তাহের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ঐতিহ্যবাহী দরবার স্কোয়ারের বেশ কয়েকটি ভবন ভেঙে পাথরের গুঁড়োয় পরিণত হয়েছে। বিশ্ব-ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত ওই স্থাপনার বেশির ভাগ ভবন প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে অক্ষত আছে নেপালের ১০ বছর বয়সী কুমারী দেবীর বাসস্থানটি। দেবদেবীর ছবি ও ভাস্কর্যসমেত কুমারী দেবীর ঘরটির কোনো ক্ষতি হয়নি বললেই চলে।

কুমারী দেবীর রক্ষকদের একজন মহেন্দ্র শাক্য এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যম ফিনানশিয়াল টাইমসকে বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর (কুমারী দেবীর) শক্তি এই পবিত্র স্থানটিকে রক্ষা করেছে।’ অবশ্য তিনি জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ঘরের ভেতরে কয়েকটি ফাটল দেখা গেছে।
 
কুমারী দেবীর ভক্তরা অবশ্য আরেক কাঠি সরেস। হিন্দুস্তান টাইমস তাঁর ভক্তদের বরাতে একটি খবরে উল্লেখ করে, এই প্রচণ্ড ভূমিকম্প নাকি একচুলও নাড়াতে পারেনি কুমারী দেবীকে। প্রবল ভূমিকম্পের সময় প্রার্থনায় বসেছিলেন ‘দেবী দুর্গার সাক্ষাৎ অবতার।’

তবে মহেন্দ্র শাক্য ফিনানশিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের সময় দেবী ছিলেন ভবনের ওপর তলায়। তখন মাত্রই দুপুরের খাবার খেয়ে উঠেছিলেন তিনি। তবে দেবী সে সময় প্রার্থনায় বসেছিলেন কি না, সে ব্যাপারটি পরিষ্কার করে জানাতে পারেননি তিনি। একইভাবে তিনি পরিষ্কার করে বলেননি, ওই ভূমিকম্পের সময় ঠিক কী আচরণ করেছিলেন কুমারী দেবী। 

সরেজমিনে দেখার কথা উল্লেখ করে ফিনানশিয়াল টাইমসে ভূমিকম্পের পর কুমারী দেবীর বাসস্থানের বর্তমান অবস্থার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে-  প্রাচীন কাঠের বড় দরজা, দ্বাররক্ষকের ভূমিকায় পাথরের দুই সিংহ। দরজায় লাল হরফে লেখা ‘জীবন্ত দেবী’। এর একটু বাইরে বুলডোজার আর উদ্ধারকারী দলের জটলা। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দরবার স্কোয়ারের ‘ঐতিহ্যের ধ্বংসস্তূপ’ সরাচ্ছে তারা।

নেপালে কুমারী দেবীকে দেশটির রক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়। দেবীকে কেউ বলে কন্যাকুমারীর পুনর্জন্ম, কেউ বা বলে দেবী দুর্গার অবতার, আবার কেউ বলে অষ্টমাতার একজন। শাক্য বংশের স্বর্ণকার বা রৌপ্যকার পরিবার থেকে চার-পাঁচ বছর বয়সেই বেছে নেওয়া হয় কুমারী মাতাকে। ওই কুমারী দেবীর শরীর হতে হবে নিখুঁত এবং নির্দিষ্ট ৩২টি চিহ্ন থাকতে হবে তাঁর শরীরে। ওই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে আছে কলাগাছের মতো শরীর, শাঁখের মতো কাঁধ ইত্যাদি।
 
এ ছাড়া দেবী নির্বাচিত হওয়ার আগে মানসিক শক্তির (নার্ভের একটি পরীক্ষা) একটি পরীক্ষাও দিতে হয় তাঁকে। যেখানে গভীর রাতে দেবীত্ব প্রার্থী শিশুমেয়েদের মন্দির চত্বরে এক গা-ছমছমে পরিবেশে মৃতদেহের সামনে নেওয়া হয়। দৈত্য দানব, শয়তান, ভূত আর মহিষের মাথার মুখোশ পরিহিতদের দিয়ে ভয় দেখানো হয় তাঁদের।
  
কুমারী দেবী হওয়ার পর থেকে দেশটির হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাঁর উপাসনা শুরু করে। দরবার স্কোয়ারের বাসস্থানে সারা বছরজুড়ে তাঁর পূজা চলে। দিনের একটা অংশ তাঁকে কাটাতে হয় ভক্তদের ভক্তি গ্রহণ করে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বসে ভক্তদের ভক্তি গ্রহণের পাশাপাশি তাঁদের মাথায় আশীর্বাদসূচক চিহ্ন এঁকে দিতে হয়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, নতুন রূপে দেবী এসেছেন এই কুমারী মাতার রূপ ধরে।

কুমার দেবীর পরিবারকে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। ধর্মীয় উৎসব ছাড়া কুমারী দেবীর বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। যখন বাইরে নেওয়া হবে, তখনো নিজের পায়ে হাঁটতে দেওয়া হয় না তাঁকে। লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করা হয় বাড়ির ভেতর গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে। তা ছাড়া নিজের পরিবারের বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগও থাকে না কিশোরী দেবীর।

নেপালের এই কুমারী দেবীদের দেবীত্ব থাকে রজঃস্বলা হওয়ার আগ পর্যন্ত। রজঃস্বলা হওয়ার পর থেকে কুমারী দেবী আর দশটা মেয়ের মতোই জীবনযাপন করেন। নেপালিদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সে কুমারী মেয়েগুলো যখন পরিপূর্ণ নারীতে পরিণত হয়, তখন তাদের কাছ থেকে দেবী দুর্গা প্রস্থান করে। সে কারণে তাদের দেবীত্বও চলে যায়।

গত ২৫ এপ্রিল স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন এলাকার পুরনো ও নতুন অনেক স্থাপনা ধসে পড়ে। আজ শনিবার পর্যন্ত ভয়াবহ ভূমিকম্পে নেপালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৬২১। এখন পর্যন্ত ভয়াবহ ভূমিকম্পে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আহতের খবর জানিয়েছে নেপাল সরকার।