ভূমিকম্পে কমে গেছে এভারেস্টের উচ্চতা
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা কত? বিভিন্ন নির্বাচনী পরীক্ষায় এ প্রশ্নের দেখা মেলে হরহামেশা। উত্তর অনেকেরই জানা- ‘আট হাজার ৮৪৮ মিটার! মানে প্রায় ৮ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। তবে নেপালের ভূমিকম্প সম্ভবত এরই মধ্যে বদলে দিয়েছে এই উত্তর!
সময়ের আবর্তে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সাম্প্রতিক প্রবল ভূমিকম্পের প্রভাবে সম্ভবত এতদিনের এই সঠিক উত্তরটি পাল্টে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম ম্যাশেবল জার্মান অ্যারোস্পেইস সেন্টারের গবেষকদের বরাতে জানিয়েছে, বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা এক থেকে দুই মিটার (তিন থেকে ছয় ফুট) কমে থাকতে পারে। একটি ইউরোপীয় ও একটি মার্কিন ভূ-উপগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা এই তথ্য জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেছে তারা।
আশি বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হিমালয়কন্যা নেপালে কেবল বিপুল প্রাণহানিই হয়নি, বদলে গেছে দেশটির ভূ-প্রকৃতিও। এর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়া কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকটোনিকস বিভাগের বিশেষজ্ঞ জেমস জ্যাকসনের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল, ভূমিকম্পে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু শহরটির তলদেশ দক্ষিণ দিকে কয়েক মিটার সরে গেছে।
গতকাল জার্মান অ্যারোস্পেইস সেন্টার ইউরোপের একটি ভূ-উপগ্রহ ‘সেন্টিনাল-১’-এর দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এএফপিকে জানিয়েছে, ভূমিকম্পে পৃথিবীর নিচের প্লেট সরে যাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ ভূ-স্তর আনুভূমিক ও উলম্বভাবে (হরাইজেন্টালি ও ভার্টিক্যালি) সরে যায়। অ্যারোস্পেইস সেন্টার ভূ-উপগ্রহের দেওয়া বর্তমান তথ্যের সাথে ভূমিকম্পের আগের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে পায়, ৬০ মাইল লম্বা এবং ১৯ মাইল চওড়া একটি অংশে ভূ-স্তরের পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে কমে যেতে পারে এভারেস্টের উচ্চতা।
এর আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ জেমস জ্যাকসন জানিয়েছিলেন, ভূমিকম্পের পর ভূমি-মাধ্যমে প্রবাহিত শব্দতরঙ্গের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে ভূকম্পনের প্রাথমিক তথ্যচিত্রে কাঠমান্ডুর নিচের অভ্যন্তরীণ ভূ-স্তর সরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁর এই গবেষণার সাথে অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌতবিজ্ঞানের প্রধান স্যান্ডি স্টিকির বিশ্লেষণেরও মিল রয়েছে।
স্যান্ডি স্টিকি জানিয়েছিলেন, ভূমিকম্পটি সম্ভবত ‘হিমালয়ান থ্রাস্ট ফল্ট’-এ হয়েছিল। ওই প্লেট সীমানা সঞ্চারণশীল ভারতীয় উপমহাদেশকে ইউরেশিয়া থেকে পৃথক করেছে। ফল্টটি (চ্যুতি) উত্তর ও উত্তর-পূর্বে প্রায় ১০ ডিগ্রি দেবে যায়। আর চ্যুতি এলাকায় আপেক্ষিক সঞ্চারণ হয়েছে তিন মিটার, যার অবস্থান কাঠমান্ডুর ঠিক উত্তরে। এ ধাক্কা প্রায় ১০ ডিগ্রির মতো উত্তর ও উত্তর-পূর্বে পড়েছে। ফলে কাঠমান্ডুর অবস্থান তিন মিটার পর্যন্ত দক্ষিণে সরে গেছে। স্টিকি ভূমিকম্পে হিমালয়ের উচ্চতা কমারও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
তবে স্টিকি ইউএস জিওলজিক্যাল জরিপ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জানিয়েছিলেন, যেহেতু ভূমিকম্পটি যে ফল্টলাইনে ঘটেছে, ঠিক সরাসরি তার ওপর অবস্থান নয় এভারেস্টের; তাই এর উচ্চতায় কয়েক মিলিমিটারের বেশি রদবদল না হওয়ারই কথা। কিন্তু জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার বলছে, তিন ফুট থেকে ছয় ফুট দেবে গেছে এভারেস্ট!
গত ২৫ এপ্রিল নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতে একযোগে আঘাত হানে শক্তিশালী এই ভূমিকম্প। উৎপত্তিস্থলে রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যানুযায়ী, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল কাঠমান্ডুর অদূরে পোখরার কাছে লামজুং। এর ২৬ মিনিট পর দ্বিতীয় এবং আট মিনিট পর তৃতীয় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। এরপর পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন মাত্রার ৬৪টি কম্পন অনুভূত হয়।
আজ থেকে প্রায় ছয় কোটি বছর আগে জন্ম নেয় হিমালয় পর্বতমালা। এভারেস্টের সৃষ্টিপর্বেও ছিল প্রবল ভূমিকম্পে ভূ-গর্ভের প্লেটে আলোড়নের প্রভাব। পৃথিবীর ভূ-গর্ভের মাটির স্তরগুলো প্লেট আকারে থাকে। প্লেটগুলো আবার বিভিন্ন উপমহাদেশীয় অঞ্চল নিয়ে গঠিত। এমনই দুটি প্লেট ভারতীয় প্লেট ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষে এই পর্বতমালা তৈরি।