কানাডা-ভারতের পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার, কার কী লাভ-ক্ষতি?

Looks like you've blocked notifications!

ভারত ও কানাডার সম্পর্কে বড় ধরনের চিড় ধরেছে। কানাডা একজন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করার পর ভারতও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে কানাডার এক কূটনীতিককে পাঁচদিনের মধ্যে দেশে চলে যেতে বলেছে, এ থেকেই এই চিড় স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বিরোধ খুব তাড়াতাড়ি মিটবে না। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুই দেশের রাজনীতিও।

ভারত ও কানাডার সম্পর্কের মধ্যে সবকিছু মসৃণভাবে চলছে না, তা কিছুদিন ধরে টের পাওয়া যাচ্ছিল। বিশেষ করে জি২০ সম্মেলনের পর তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়নি। কেবল ১০ মিনিটের আলোচনা করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানেও রীতিমতো কড়া বাক্য বিনিময় হয়েছে। এরপর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করে দিয়েছে কানাডা। তারপর এসেছে কূটনীতিককে অভিযুক্ত করে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত। ফলে সবদিক থেকে সমস্যা বেড়েছে।

কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে?

ভারত ও কানাডার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে খুবই ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, যে জায়গায় এখন এই সম্পর্ক পৌঁছে গেল, তার প্রভাব দুই দেশের বাণিজ্যে পড়তে পারে।

সাবেক আইপিএস অফিসার ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘কানাডা যেভাবে ভারতীয় কূটনীতিককে বের করে দিলো, তাতে বোঝা যাচ্ছে—দুই দেশের সম্পর্ক এখন কতটা খারাপ।’

ভারতীয় এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের মতে, ‘আমাদের কড়া নীতি নিয়ে চলতে হবে। তাতে যদি দুই দেশের বাণিজ্য-সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় তো হবে। আমাদের কিছু করার নেই। একটা কথা বুঝতে হবে, কানাডা যা করেছে, তা করে ভালো সম্পর্ক রাখা যায় না।’

প্রবীণ সাংবাদিক ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা বলেন, ‘সব দেশই এখন ভারতের বাজারকে ধরতে চাইছে। কারণ, ভারতের অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি হচ্ছে। তারপরেও ট্রুডো ভারতের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করে রেখেছেন। এখন এটাই কাম্য, দুই দেশ সমস্যা কাটিয়ে আবার বন্ধুত্বের পথে চলুক।’

উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের মাইকেল কুগেলম্যান এএনআইকে বলেন, ‘আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। ভারতের সঙ্গে কানাডার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সেখানে কূটনৈতিক সম্পর্কের এই জটিলতা অবাক করার মতো।’

২০২২ সালে ভারত ও কানাডার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। ভারত ছয় দশমিক চার বিলিয়ন ডলারের জিনিস পাঠিয়েছে, আর কানাডার জিনিস ভারতে এসেছে চার দশমিক এক বিলিয়ান ডলারের।

এছাড়া কানাডার পেনশন ফান্ড এবং অন্টারিও টিচার্স পেনশন প্ল্যান ভারতের বাজারে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ভারতে কানাডার ৬০০টি কোম্পানি আছে। তাছাড়া কানাডার এক হাজার কোম্পানি ভারতের বাজারে বাণিজ্য করে। ফলে এই সংঘাতের প্রভাব বাণিজ্যে পড়লে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রাজনীতির জন্য?

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুজনকেই কিছুদিনের মধ্যে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। মোদিকে প্রথমে আগামী বছরের এপ্রিল-মে নাগাদ। আর ট্রুডোকে ২০২৫ সালে। এই যে কূটনৈতিক লড়াই, তার পেছনে কি রাজনীতিও রয়েছে?

শান্তনু মুখোপাধ্যায় সোজাসাপটা বলেন, ‘রাজনীতি তো আছেই। নাহলে এটা কেন হবে? ট্রুডোর মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিপক্কতা দেখতে পাচ্ছি না। খুবই অপেশাদারের মতো কাজ করেছেন ট্রুডো। এর মধ্যে নিশ্চয়ই ওদের অভ্যন্তরীণ বিষয় আছে। সেখানকার রাজনীতি আছে। কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমি বলতে পারি, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে খেলছেন। নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য এটা করছেন।’

প্রবীণ সাংবাদিক ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা বলেন, ‘শেষ যে সমীক্ষার ফলাফল এসেছে, তাতে দেখা গেছে—ট্রুডো প্রধান বিরোধী রক্ষণশীল দলের থেকে অনেকটা পিছিয়ে। তাদের জনপ্রিয়তা ৪০ এর ঘরে, ট্রুডোর ২০এর ঘরে। ট্রুডোকে ২০২৫ সালে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। সেজন্য সম্ভবত তিনি এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে চান না, যাতে তার মূল ভোটে কোনো প্রভাব পড়ে।’

প্রণয় শর্মা বলেন, ‘শিখদের প্রতি ট্রুডোর দুর্বলতার কারণ, তারা তার ভোটব্যাংকের বড় অংশ। এর আগেও তিনি শিখদের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সেখানে একবারের জন্যও ভারতীয় বিমান কনিষ্ক ধ্বংস নিয়ে একটা কথাও বলেননি। অথচ এই দুর্ঘটনায় কানাডার মানুষই মারা গিয়েছিলেন। এর জন্য কানাডায় ট্রুডো সমালোচিত হয়েছিলেন।’ 

কুগেলম্যান বলেন, ‘কিছুটা রাজনীতি থাকতেই পারে। তবে শুধু রাজনীতির জন্য ট্রুডো এই জায়গায় যাবেন বলে মনে হয় না।’ 

দ্য ক্যারাভান পত্রিকার সম্পাদক হরতোষ বাল আলজাজিরাকে বলেন, ‘খালিস্তানের বিষয়টি মোদি ও বিজেপিকে ঘরোয়া রাজনীতিতে সাহায্য করে। কারণ, তারা দেশের নিরাপত্তার সামনে বিপদ নিয়ে প্রচারণা করে। গত কয়েক দশক ধরে খালিস্তানি আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও বারবার এ নিয়ে হইচই হয়।’

প্রণয় শর্মা বলেন, ‘ট্রুডো আগেও এ রকম কাজ করেছেন। ২০১৬ সালে চীনে গিয়ে সেখানে মানবাধিকার নিয়ে প্রবল সমালোচনা করে দুই দেশের সম্পর্ক জটিল করে দিয়েছিলেন। এরপর জার্মানিরও সমালোচনা করে জটিলতা বাড়িয়েছেন।’

সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন

কানাডা বলছে, এটা তাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। ট্রুডো বলেন, ‘ভারতের প্রধান গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা রীতিমতো চিন্তিত। আমি প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে স্পষ্টভাবে এই চিন্তার কথা জানিয়েছি। কানাডার মাটিতে, কানাডার কোনো নাগরিককে হত্যার সঙ্গে যদি কোনো বিদেশি শক্তি জড়িত থাকে, তাহলে তা সার্বভৌমত্ব লংঘন করার ঘটনা। এটা মানা যায় না।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘তারা (কানাডা) উন্নত দেশ। প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে। তারা খোঁজ নিক। হঠাৎ বলা যে ভারত মেরেছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তোমাদের এত ভালো নিরাপত্তা ও তদন্তের ব্যবস্থা আছে। তারপরেও তো কনিষ্ক বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে তোমরা ব্যর্থ হলে, আরও নানা বিষয়ে ব্যর্থ হলে, আর এক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ না দিয়ে বলে দেওয়া হলো—ভারত দায়ী। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি এটা মেনে নিতে পারি না।’

‘র’ এর নাম টেনে আনার প্রসঙ্গে শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘বোঝা যাচ্ছে, সম্পর্ক কত খারাপ হয়ে গেছে। ওরা কতটা ডেসপারেট। তোমার দেশে একজন মারা গেল। ভারত তো কানাডা থেকে কতদূরে। আমাদের ওপর দায় চাপিয়ে দিলে। এর পাল্টা পদক্ষেপ ভারতও নেবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশও যথেষ্ট শক্তিশালী।’

কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা বলেন, ‘ভারত অনেকদিন থেকে কানাডায় খালিস্তানি তৎপরতার কথা বলছে। কানাডা তা নিয়ে কিছু করেনি। ওরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছে। ইউরোপের অনেক দেশ আগে এই কথা বলত। এখন ফ্রান্সসহ অনেকে তাদের মত বদলাচ্ছে। তারা এখন অনেক কড়া আইন এনেছে।’

প্রণয় শর্মা বলেন, ‘অনেক দেশ আইন করে বলেছে, সন্ত্রাসবাদকে গ্লোরিফাই করা হলে, সেটাও আপরাধ। কিন্তু কানাডা এই বিষয়ে উদাসীন। কিছুদিন আগে খালিস্তানপন্থিরা কানাডায় একটা ট্যাবলো বের করে। সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারীদের গ্লোরিফাই করা হয়েছিল।’ 

এই কূটনীতি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যখন গোয়েন্দাদের দূতাবাসে পোস্টিং করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট দেশ সেটা জানে। আমরাও জানি, অন্য দেশের দূতাবাসে তাদের কোন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আছেন। কিন্তু, সচরাচর তা জনসম্মুখে আনা হয় না।’

কানাডায় ভারতীয়দের ওপর প্রভাব কী?

ক্যানাডার মোট জনসংখ্যা হলো তিন কোটি ৮২ লাখ। এর মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা পাঁচ শতাংশের সামান্য বেশি। ১৮ লাখের মতো ভারতীয় সেখানে আছেন। তার মধ্যে শিখদের সংখ্যা আট লাখের মতো। ভারতের পরেই কানাডাতে সবচেয়ে বেশি শিখ বসবাস করেন।

প্রণয় শর্মা বলেন, ‘এই ধরনের টেনশন বাড়লে, কোথাও না কোথাও তো তার প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে। তারা ভারতে আসেন। এখানে তাদের আত্মীয়রা আছেন। কিন্তু, সম্পর্ক খারাপ হলে তার প্রভাব তাদের ওপর পড়বে।’

শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হলে মানুষ চিন্তিত হবেন। তাদের হয়তো শারীরিকভাবে হেনস্তা হতে হবে না, কিন্তু কানাডায় ভারতীয়রা উদ্বিগ্ন হবেনই। এটা স্বাভাবিক।’

সাংবাদিক শরদ গুপ্তর মেয়ে কানাডায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। সেখানে সাধারণত মানুষের মধ্যে এ ঘটনার প্রভাব বিশেষ পড়ে না, যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।’

এরপর কী হবে?

কুগেলম্যান বলেন, ‘ট্রুডো হয়তো ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। কিন্তু, তিনি খুব গুরুতর অভিযোগ করেছেন। এখন এটা কূটনীতিকদের কাছে চ্যালেঞ্জ, তারা কত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারবেন। তবে খুব তাড়াতাড়ি কিছু হবে বলে মনে হয় না।’

শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘কানাডা কড়া সিদ্ধান্ত নিলে ভারতকে কড়া ব্যবস্থা নিতেই হবে। তাতে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হলে হবে। কিছু করার নেই। বাণিজ্য খারাপ হলেও কিছু করার নেই।’

প্রণয় শর্মা বলেন, ‘কানাডা নিশ্চয়ই পরিপক্কতা দেখাবে। বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবস্থা নেবে। ট্রুডো নিজের দেশের মানুষকে দেখানোর জন্য এভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর রেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পড়েছে। তিক্ততা বেড়েছে। আবার স্বাভাবিক জায়গায় ফেরার জন্য দুই দেশের সরকারের চেষ্টা করা উচিত।’