ফিলিস্তিন প্রশ্নে দুই রাষ্ট্র সমাধান ‘বিলুপ্তির পথে’ : জাতিসংঘ মহাসচিব

ফিলিস্তিন প্রশ্নে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ‘প্রায় একটি অপ্রতিরোধ্য সংকটসীমায় পৌঁছে গেছে’ বলে কঠোর সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বুধবার (৩০ এপ্রিল) সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বিতর্কে মঙ্গলবার দেওয়া বক্তব্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এই অঞ্চল এক মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—যেখানে একদিকে যেমন সহিংসতা ও অস্থিরতা বাড়ছে, তেমনি শান্তির সম্ভাবনাও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তবে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত : ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে নিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যারা একে অপরের পাশে শান্তি ও নিরাপত্তায় বসবাস করবে এবং যাদের রাজধানী হবে জেরুজালেম।
তবে মহাসচিব গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতি আজ ‘প্রায় বিলুপ্তির পথে’ এবং ‘এই বহুল আলোচিত লক্ষ্যের প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গীকার এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে’।
গুতেরেস উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে—গাজায় অব্যাহত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ধ্বংসলীলা, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান অভিযান এবং পূর্ব জেরুজালেমসহ বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব অমানবিক ঘটনা ঘটছে একটি সুস্পষ্ট দায়মুক্তির সংস্কৃতির অধীনে।
জাতিসংঘ প্রধান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘বিশ্ব নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে দুই রাষ্ট্র সমাধানের অবলুপ্তি দেখতে পারে না।’ তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সামনে এখন তিনটি সুস্পষ্ট পথ তুলে ধরেন : নীরব থেকে পরিস্থিতি মেনে নেওয়া, হতাশ হয়ে আত্মসমর্পণ করা, অথবা কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মানবিক সাহায্যকে সামরিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যের বিষয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন গুতেরেস। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইউএনআরডব্লিউএসহ সব মানবিক সহায়তায় কোনো প্রকার বাধা থাকা উচিত নয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব আরও জোরালোভাবে বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে সব জিম্মির মুক্তি এবং একই সঙ্গে প্রয়োজন একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি।’
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়ে মহাসচিব বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিজেদের প্রভাব ব্যবহার করতে হবে, যাতে দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি আর বিস্তার লাভ করতে না পারে। সব পক্ষকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে।
গুতেরেস দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের অবশ্যপালনীয় দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তাদের জনসংখ্যার খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দেওয়া এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থার কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসরায়েলের সুস্পষ্ট কর্তব্য।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামগ্রিক দায়িত্ব হলো এই অবিরাম দখলদারি ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতা থামানো। আগামী জুনে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিতব্য উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনকে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখছেন। এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সমর্থনকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সবশেষে মহাসচিবের স্পষ্ট বার্তা, ‘এটা কেবল কথার ফুলঝুরি হলে চলবে না। সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এখন সাহস দেখাতে হবে—প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এই প্রশ্ন শুধু ফিলিস্তিনি বা ইসরায়েলিদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি সমগ্র অঞ্চলের এবং মানবতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।’