‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র আলোয় বঙ্গবন্ধু
বাঙালির জীবনে আগস্ট নিষ্ঠুরতম মাস। কারণ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে প্রাণ হারান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই আগস্ট বাঙালির শোকের মাস। বাংলার আকাশ-বাতাস-নিসর্গ প্রকৃতিরও অশ্রুসিক্ত হওয়ার মাস। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর বিশাল অস্তিত্ব পড়ে আছে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে। যাঁর জন্ম না হলে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হতো না।
২.
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে এবং তাঁর মাত্র ৫৫ বছরের জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব, শেখ মুজিব তাঁর জীবনের প্রতিটি কালপর্বে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগ, শ্রম ও মেধার স্বাক্ষর রেখেই অগ্রসর হয়েছেন। তাই তিনি বাঙালি চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো অগ্রজ নেতাদের ছাড়িয়ে শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনের এই অসমাপ্ত কিন্তু অসামান্য আত্মজীবনী এমন অসংকোচ সত্যেরই এক অনন্য নিদর্শন এবং জাতির জন্য একটি অনিঃশেষ আলোকবর্তিকা বিশেষ। গ্রন্থটি যত বারই পাঠ করি তত বারই যেন নবরূপে, নতুন করে খুঁজে পাই বঙ্গবন্ধুকে। এ এক রহস্যময় পাঠ অভিযাত্রা। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতার সংগ্রামী জীবন ও নান্দনিক কিছু ভাবনার অসাধারণ উপস্থাপন এই গ্রন্থটি আমাদের জাতীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আকরগ্রন্থ। এতে ১৯৪৭ সালের বিভাগ-পূর্ব বাংলা ও বিভাগ-উত্তর পাকিস্তানি শাসনের গোড়ার দিকের বঙ্গবন্ধুর জীবনঘনিষ্ঠ বিচিত্র ঘটনাবলি মূর্ত হয়েছে। নিজ নেতৃত্ব ও কর্মগুণে সমকালীন রাজনীতিকদের অনেকককে ছাপিয়ে তাঁর নেতৃত্বের উত্থান ইতিহাসের কালপর্ব গ্রন্থে দেদীপ্যমান। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথায় ব্যক্ত বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক মানস-গঠন, নীতি-আদর্শ-নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক দর্শন, ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় তাঁর নেতৃত্ব ও অনন্য ভূমিকা, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কারাস্মৃতি ইত্যাদি বিষয় পূর্বাপর সময়ের ছবি আমরা পাঠ করে সঠিক ইতিহাসের কাছে আরও গভীরভাবে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ি। পাঠ শেষে বলতেই পারি, মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা অকৃত্রিম ছিল বলেই তিনি হারিয়ে যাওয়ার নন, বরং সময়ের পথচলায় আরও বেশি জীবন্ত, আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে বারবার তিনি ফিরে আসেন মানুষের কাতারে।
৩.
বাংলাদেশের আবির্ভাবের পটভূমি তৈরি করে দেওয়া ভারত বিভাগ থেকে শুরু করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সূচনালগ্নে পাকিস্তানের রাজনীতির নানা রকম ঘটনা ও সেই সময়ের শাসকগোষ্ঠীর কূটচালের সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ যে ইতিহাস বঙ্গবন্ধু রচনা করে গেছেন, তাঁর সহজ ভাষা ও অলংকারবর্জিত বর্ণনার মধ্য দিয়ে সেই সময় ও রাজনীতির চিত্র সজীব হয়ে ওঠে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। গ্রন্থটি একদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমূল্য দলিল। অন্যদিকে, একটি বইয়ের পাতায় পাতায় নিজের জবানিতে বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ইতিহাস। একটি ডায়েরিতে একটি জাতির জন্মের কথা অকপটে লিখেছেন একজন আলোকিত মানুষ। বইটির অনেক দিকই আমার ভালো লেগেছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে বঙ্গবন্ধু কী করে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, সেই হয়ে ওঠার ইতিহাসটি জানতে পেরে। বইটি থেকে জানা যায়, কলকাতায় দাঙ্গার সময় তিনি সৈনিকের মতো বন্দুক নিয়ে টহল দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মুসলমান-হিন্দু সকল এলাকার মানুষকেই রক্ষায় নির্ভয়ে সেবায় কাজ করেছেন। বিভিন্ন জনের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হচ্ছে, আবার থেমেও থাকছেন না সে কারণে। এই মানুষটি কীভাবে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলেন যে, আমাদের পাকিস্তানে স্থান নেই। যদিও বইটি ১৯৫৪ সালে এসে শেষ হয়েছে, তবুও বইটি পড়লে এই বিষয়টি সুন্দরভাবে বোঝা যায়। আমরা জানি, এই বইটি কারাগারে বসে লেখা। কারাগারের খুঁটিনাটি সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে। তাঁকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমরা ভালোবাসি। বইটি পড়লে তাঁকে আমরা একজন মানুষ হিসেবে আরও বেশি ভালোবাসব বলেই আমার বিশ্বাস।
৪.
আমাদের নতুন প্রজন্ম বইটি পড়লে মানুষ বঙ্গবন্ধুকে জানবে। এই বইটি পড়লে সঠিক ইতিহাস জানা যাবে, আর প্রকৃত সত্য ইতিহাস না জানলে ভবিষ্যত অন্যরকম হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বইটি পড়ে রাজনীতির কবিকে হয়ে ওঠার ইতিহাস যেমন জানবে, তেমনই দেশের রাজনীতির অজানাকেও জানবে, ফলে তারা উপকৃত হবে; এ নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকার কারণ নেই। এই বইয়ে তিনি তাঁর জন্ম, তাঁর পরিবারের ইতিহাস ও কিংবদন্তি, শৈশব, ছাত্রজীবন, বেড়ে ওঠা, ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরু করে ১৯৫৪-৫৫ সাল পর্যন্ত জীবনকাহিনি বর্ণনা করেছেন; তাতে সবচেয়ে আড়াল করে রেখেছেন নিজের গৌরব বা কীর্তি, একজন নিপুণ কথাকারের মতো গল্প বলে গেছেন, ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, পরিবেশ ফুটিয়ে তুলেছেন, চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছেন, সংলাপ তৈরি করেছেন, এর ফলে মনেই হয় না এটি একজন লেখকের প্রথম বই, কিংবা লেখক আসলে পেশাদার লেখকই নন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করি একজন চমৎকার লেখক হিসেবে, গল্পের কথক হিসেবে। বইটি পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল, কী সুন্দর করে গল্প বলতে পারেন তিনি, তাঁকে বলা যায় একজন অনবদ্য গল্পকার, একজন অসাধারণ কথাকার, ‘এ গ্রেট স্টোরিটেলার’। সেই অমর কথাশিল্পী বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যেন দেশপ্রেমেরও এক অনুপম কাব্যকথা। এই গ্রন্থটি যেন বাংলার সংগ্রামমুখর ইতিহাসের একটি অসামান্য দলিল, আমাদের সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
৫.
আত্মকথা লেখা বড় কঠিন। সত্য কথা স্পষ্ট করে বলতে পারাটাই একটা মহৎ কাজ। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক নেতা থেকে বাঙালি জাতির জনক হয়ে ওঠেন এবং বাংলাদেশের স্রষ্টাও তিনি। তাঁর এই মহত্তর হয়ে ওঠার তথ্য, ঘটনা এবং ব্যক্তিজীবনের কথা তিনি তাঁর প্রিয় সহজ, সরল, আপামর শোষিত সাধারণ জনগণের দিকে তাকিয়ে করে গেছেন। ইতিহাস তাই তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে, ইতিহাস তাঁর এই শ্রেষ্ঠ কীর্তিকেও অমূল্য সম্পদ হিসেবে রক্ষা করবে। নতুন প্রজন্মকে আদর্শ ও সততায় আলোকবর্তিকা হয়ে উজ্জীবিত করবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বাঙালির ও বাংলার সংগ্রামমুখর ইতিহাসের একটি অসাধারণ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বাঙালির জীবনে অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।