এক শ্রেণির মানুষ বাংলা লেখা ও বলার ক্ষেত্রে ভীষণ উদাসীন : ইকবাল খোরশেদ

Looks like you've blocked notifications!

লেখক, নাট্যকার, নির্দেশক, আবৃত্তিকার, প্রশিক্ষক, সাংবাদিক ইকবাল খোরশেদ পাক্ষিক পত্রিকা আনন্দভুবনের সম্পাদক। পেশায় সাংবাদিক হলেও নেশায় আবৃত্তিকর্মী, বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত নাট্যকার, পাণ্ডুলিপি লেখক ও সঞ্চালক। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ এর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রকাশনা সম্পাদক ও আবৃত্তি সংগঠন ‘মুক্তবাক’র কর্ণধার। ১৯৬৬ সালের ৩০-এ জুন নোয়াখালির মাইজদিতে জন্ম নেওয়া এই সাংবাদিক, আবৃত্তিশিল্পী বাংলা ভাষা ও আবৃত্তি নিয়ে তার ভাবনা ও গবেষণার কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনকে।

প্রশ্ন : আপনি বিবিধ বিষয়ে কাজ করলেও মূলত আপনার কাজ ভাষা নিয়ে। এই ভাষার মাসে ভাষা নিয়ে কী কাজ করছেন?

উত্তর : আমার কাছে আলাদা করে কোনো ভাষার মাস নেই। সব মাসই ভাষার মাস। আমি সব মাসেই ভাষা নিয়ে কাজ করি। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের একটি মাইলফলক, কেননা, ওই দিন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছাত্রদের মিছিলে গুলি বর্ষণ করলে ছাত্র-জনতা নিহত হয়। বাংলা ভাষার আন্দোলন শুরু হয়েছিল কিন্তু সেই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের পরপরই। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ তারিখের কথাও আমরা সবাই জানি। সেদিন বাংলা ভাষার দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়, সেটি ছিল ভাষার দাবিতে প্রথম সার্থক ধর্মঘট। ওইদিন কর্মসূচি পালনকালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীন পাকিস্তানে ওটাই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম কারাবরণ। ভাষা আন্দোলন যে কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই হয়েছিল তা নয়। এখন একুশে ফেব্রুয়ারি গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়, শহীদবেদিতে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলা হয়। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস হিসেবে জাতিসংঘের ঘোষণার পর এর গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। সারা পৃথিবীর মানুষ এই দিনে নিজের নিজের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।  সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের গায়ে ‘ভাষার মাস’-এর একটা তকমা লেগে গেছে। তার মানে এই নয় যে, কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই ভাষা নিয়ে কাজ করবো অন্য কোনো মাসে করবো না। বাংলাদেশ বেতারে প্রতি সোমবার সকাল সাড়ে সাতটায় আমার গবেষণা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় বাংলা ভাষা শিক্ষার অনুষ্ঠান ‘আমার বাংলা ভাষা’ প্রচারিত হচ্ছে নিয়মিত।

প্রশ্ন : বাংলা ভাষার চর্চা কেমন হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : ভাষা প্রতিদিন চর্চার বিষয়। এটা যে একেবারে বই-খাতা নিয়ে সবাইকে চর্চা করতে হবে তা নয়, দৈনন্দিন কথাবার্তায়, কাজকর্মের মধ্যদিয়ে আমি আমার মাতৃভাষার চর্চা করতে পারি। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। যে জাতির মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা চর্চার প্রতি একশ্রেণির মানুষের অনীহা ও অবেহেলা আছে, তারা মনে করে, বাংলা শেখার কিছু নেই, কিংবা এটা শিখলে কোনো লাভও নেই- ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে বা লিখতে পারলে একদিকে যেমন স্মার্টনেসের প্রকাশ ঘটে অন্যদিকে তেমনি চাকরি-বাকরি পেতে সহজ হয়। সে-কারণে তারা বাংলা লেখা এবং বলা উভয় ক্ষেত্রেই ভীষণ উদাসীন। আবার ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু সমস্যাও আছে- আমাদের পত্র-পত্রিকায় এমন কিছু বানান ও শব্দ প্রয়োগ করা হয় যেগুলো শুদ্ধ ভাষাচর্চায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ‘কিংবদন্তি’ শব্দের অর্থ জনশ্রুতি। এখন পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বুঝে-না-বুঝে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির নামের আগে ‘কিংবদন্তি’ শব্দটি জুড়ে দিচ্ছে, ইদানীং এই প্রবণতা খুব বেড়েছে- এতে সাধারণ মানুষের কাছে শব্দটি কিন্তু ভুল অর্থ বা ভুল তথ্য নিয়ে হাজির হচ্ছে। বিশেষ অবদান রেখেছেন এমন বিশিষ্টজনের নামের পূর্বে যদি আপনাকে বিশেষণবাচক কোনো শব্দ লিখতেই হয় তাহলে আপনি ‘অনন্যসাধারণ’, ‘প্রবাদপ্রতিম’ এমন লিখতে পারেন, ‘কিংবদন্তি’ নয়। তা ছাড়া লেখার দরকারই-বা কি? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম বা লালন শাহ্-এর নামের আগে তো ‘কিংবদন্তি’, ‘প্রবাদপ্রতিম’ এমন বিশেষণ লেখার দরকার হয় না। বিশিষ্টজনের নামই একটা ‘বিশেষণ’। মনে রাখা জরুরি ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম, তাই একে যত সহজ করা যায়, ততই যোগাযোগ সহজ হয।

প্রশ্ন : অনেকে বলেন বাংলা কঠিন ভাষা, এই জন্য এর চর্চা করাও কঠিন, আপনি কী মনে করেন?

উত্তর : কোনো ভাষাই কঠিন নয়, যদি ঠিকভাবে চর্চা করা হয়। আপনি ইংরেজি যখন চর্চা করেন তখন লিখছেন Put-বলছেন ‘পুট’, লিখছেন But- বলছেন ‘বাট’, বানান এক কিন্তু উচ্চারণ দুই রকম। এমন সব ভাষাতেই আছে- বরং বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ভাষা। রোমান বর্ণমালা (যেটি ব্যবহার করে ইংরেজি লিখতে হয়, ইংরেজি ভাষার কোনো নিজস্ব বর্ণমালা নেই) তো বটেই পৃথিবীর যেকোনো বর্ণমালার তুলনায় বাংলা বর্ণমালা সমৃদ্ধ এবং বিজ্ঞানসম্মত। আপনি রোমান বর্ণ দিয়ে ‘বাড়ি’ শব্দটি লিখতে পারবেন না, লিখতে হবে Bari। ইংরেজি ভাষা বা রোমান হরফের এমন আরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলায় কিন্তু এমন নয়; এমন কোনো ধ্বনি নেই যেটি বাংলা বর্ণমালা দিয়ে লিখে প্রকাশ করা যায় না। তবে হ্যাঁ বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে রচিত, তাই ব্যাকরণের অংশ কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে। তবে, মনোযোগ দিয়ে শিখলে সেটা আপনাকে ভাষাচর্চা করতে সহায়তা করবে। এর পাশাপাশি আমি এও বলতে চাই যে, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত একটি বাংলা ব্যাকরণ বই রচিত হওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন : একদিকে আপনার লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনা, আবার বেতারের জন্য নাটক রচনা বা পাণ্ডুলিপি রচনা ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, এর মধ্যে কোনটা বেশি ভালো লাগে?

উত্তর : ভালো লাগে বলেই এই কাজগুলো করি, নইলে ব্যবসা করতাম কিংবা ব্যাংকে চাকরি করতাম।

প্রশ্ন : আপনি আবৃত্তি নিয়ে কাজ করেন। আবৃত্তি নিয়ে আপনার একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। নতুন কী কাজ করার পরিকল্পনা আছে?

উত্তর : উচ্চারণ চর্চার জন্য ‘বাংলা উচ্চারণের নিয়মকানুন’ এবং আবৃত্তিচর্চার জন্য ‘কবিতা ও আবৃত্তির কথা’ শিরোনামের বই দুটি বেরিয়েছে ‘মূর্ধন্য’ থেকে আর আবৃত্তিযোগ্য ছয়শো কবিতা নিয়ে ‘জোনাকী প্রকাশনী’ বের করেছে ‘আবৃত্তির শ্রেষ্ঠ কবিতা সমগ্র’। ‘ইকবাল খোরশেদ আবৃত্তি আবাস’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল যাত্রা শুরু করেছে, এতে আমার নিজের আবৃত্তি তো থাকছেই এর পাশাপাশি এখানেও আবৃত্তি নিয়ে ভিন্ন মাত্রার কিছু কাজ করবো। সেগুলো ক্রমশ প্রকাশ্য-

প্রশ্ন : আমাদের দেশে আবৃত্তি সংস্কৃতি জগতের একটি বড়ো জায়গাজুড়ে। আবৃত্তি বিষয়ে বাংলা ভাষায় যে সব বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে, সেটা কী যথেষ্ট মনে করেন?

উত্তর : দেখুন, যখন কোনো বইপত্র ছিল না, তখন গোলাম মুস্তাফা, শম্ভু মিত্র, কাজী সব্যসাচীরা আবৃত্তি করেছেন। তাদের আবৃত্তির মানকে এখনও উত্তর প্রজন্মের কেউ অতিক্রম করা তো দূরে থাক স্পর্শও করতে পারেনি- এটা আমার মত, অন্যের ভিন্ন মত থাকতে পারে। বইপত্র যা আছে তা একেবারে অপ্রতুল নয়, কিন্তু সেগুলো পড়ছে কয়জনে? একটা কবিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে, অনেকে আবার অগ্রজ কোনো নামকরা আবৃত্তিরকারকে কপি করছে- বিরাট আবৃত্তিশিল্পী হয়ে গেছে, বেশিরভাগেরই অবস্থা হলো এই- আর প্রকৃতিপ্রদত্ত কণ্ঠস্বর যদি একটু মোটা (পুরুষের) কিঙ্কিনি (নারীর) হয় তাহলে তাকে রোধে সাধ্য কার? প্রকৃতপক্ষে, যেকোনো শিল্প নিজের অন্তরে ধারণ করবার বিষয়, নিবিড় চর্চা করবার বিষয়- নিজের একটা বোধ ও শৈলী (স্টাইল) তৈরি করা জরুরি। সেটা করতে পারছে ক’জন? এই জন্যই পঠনপাঠন খুব প্রয়োজন। আমাদের একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, আবৃত্তি মানে recitation নয়, আবৃত্তি মানে interpretation। আর এই দুয়ের মাঝের ফারাক বোঝার জন্যই আবৃত্তিবিষয়ক বইপত্র পড়া উচিত।