কুরোসাওয়া কথা
মুরাসাকি ও শোনাগন
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আত্মজীবনী ধরনের এ বইটি লিখব বলে যখন ঠিক করলাম, তখন উয়েকুসা কেইনোসুকের সঙ্গে অতীত দিনগুলো নিয়ে আলাপ করেছিলাম। কুরোদা প্রাইমারি স্কুলটি যেখানে ছিল, হাত্তোরিজাকা নামের সেখানকার পাহাড়ি রাস্তাটি ছিল কেমন—সেই কথা সে আমাকে বলেছে। একবার তাকে আমি বলেছিলাম, ‘তুমি হলে মুরাসাকি শিকিবু, আর আমি সেই-শোনাগন।’ এ কথা বলার ঠিক কারণ ঠিক কী ছিল—মনে পড়ে না আমার।
এমনটা সম্ভব নয় যে, প্রাইমারি স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে মুরাসাকির ‘টেলস অব গেঞ্জি’ [১০০৮] কিংবা শোনাগনের ‘পিলো বুক’ [১০০২] বই দুটি আমরা পড়েছিলাম; এগুলো লেখা হয়েছিল হেইয়ান যুগের [৭৯৪-১১৮৫] মাঝামাঝি কালে। কিন্তু এ বেলা এসে এ প্রসঙ্গে সতর্কতার সঙ্গে ভেবে দেখেছি, আমার ক্যালিগ্রাফি ক্লাসের পরে যখন মিস্টার তাচিকাওয়ার বাসায় যেতাম, তিনি আমাদের জাপানের প্রথম যুগের সাহিত্যের এই ক্ল্যাসিক লেখাগুলোর কথা ভীষণভাবে শোনাতেন। উয়েকুসাও সাধারণত সেখানে থাকত, আমার জন্য অপেক্ষা করত, এবং আমাদের এই সাবেক শিক্ষকটির বাসায় আমরা অগুণতি আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। ফলে আমার ধারণা, দেঞ্জু অঞ্চল ও এদোগাওয়া নদীর মধ্যবর্তী পাহাড়ি পথ ধরে বাড়ি ফেরার পথে আমরা এ নিয়ে আলাপ করে থাকতাম।
তা ছাড়া নিজেদের মুরাসাকি শিকিবু ও সেই শোনাগনের সঙ্গে তুলনা করার আইডিয়াটি অসংলগ্ন আত্মাম্ভরিতারই ফল। ততদিনে আমার মধ্যে শিশুতোষ আলাপচারিতার একটি অভ্যাসও নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছিল : উয়েকুসার আলাপগুলো যেখানে ছিল দীর্ঘ বর্ণনায় ভরা, সেখানে আমি খুবই সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় চমকে দিতাম সব সময়।
আমার জীবনের তখনকার সময়ের বন্ধুদের মধ্যকার যেকোনো ঘটনার সময়ই উয়েকুসা আর আমি—দুজন এতই একসঙ্গে থাকতাম, ফলে কেবল ওর কথাই মনে করতে পারি আমি। কিন্তু আমাদের পারিবারিক জীবন ছিল একেবারেই আলাদা: ওর বাড়িতে ছিল শহুরে পরিবেশ, আর আমার বাড়িতে সামুরাই আবহ। যখনই আমরা দুজন পুরনো দিনগুলো নিয়ে আলাপ করি, এমন সব জিনিসের কথা সে স্মৃতিচারণ করে—যেগুলো আমার স্মৃতি থেকে একেবারেই আলাদা ধরনের।
যেমন ধরুন, কোনায় সাদা চিত্র আঁকা নিজের মায়ের কিমোনোর একটি বহুমাত্রিক ছবি সযত্নে মনে পুষে রেখেছে উয়েকুসা। ওর আরো মনে আছে, আমাদের ক্লাসের গার্লস গ্রুপের লিডার, স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির কথা—যার বাড়ি ছিল এদোগাওয়া নদীর পাড়ে, ওতাকি অঞ্চলে; মেয়েটির নামও মনে আছে ওর, আমাকে বলেছে, ‘মেয়েটির প্রতি তোমার খুব টান ছিল বলেই মনে হতো, কুরো-চান।’ অথচ এ সংক্রান্ত কোনো স্মৃতিই এখন আর মনে পড়ে না আমার।
যা মনে পড়ে, তা হলো—কেন্দোতে আমি দিন দিন আরো উন্নতি করছিলাম, এবং প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির তৃতীয় সাময়িকীতে হয়ে গিয়েছিলাম সাব-ক্যাপ্টেন। আর উপহার হিসেবে বাবা আমাকে দিয়েছিলেন ব্ল্যাক কেন্দো আর্মারের একটি স্যুট। মনে পড়ে, একটি ফেন্সিং ম্যাচে, রিভার্স বডি টুইস্ট-সহকারে পরপর পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দিয়েছিলাম আমি। মনে পড়ে, বিপক্ষ দলের অধিনায়ক ছিল জনৈক ধোপার ছেলে, এবং যখন আমাদের লড়াইটি বেশ জমে উঠেছে, তখন গাঢ়-নীল রঞ্জক পদার্থের একটা বিদ্ঘুটে গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল সে। কী এক কারণে, এই মার্শাল স্পিরিটের সকল স্মৃতিই আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে এখন!
এগুলোর মধ্যে একটি ঘটনাই আমার মনে সবচেয়ে বেশি গাঢ় হয়ে আছে। ঘটনাটি আরেকটি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রদের অতর্কিত আক্রমণের শিকার আমি হওয়ায়। ওচিআই ফেন্সিং স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে, এদোগাওয়াবাশি ব্রিজের কাছাকাছির একটি মাছের দোকানের সামনে পৌঁছেছিলাম তখন। দোকানটির সামনে আমার চেয়ে খানিকটা বয়সে বড় সাত-আটজন ছেলে আগে থেকেই জড়ো ছিল, তাদের চেহারা আমি চিনতে পারিনি। তাদের হাতে ছিল বাঁশের তলোয়ার, বাঁশের খুঁটি আর লাঠি।
এলাকাটিও ছিল সেই ছেলেদেরই। যেহেতু এটি কুরোদা প্রাইমারি স্কুলের এলাকা নয়, এবং এই ছেলেরা আমার দিকে আজব এক ভাব নিয়ে তাকিয়ে ছিল, ফলে আমি দাঁড়ালাম। কিন্তু যখনই একটা বালক সোর্ডম্যান তার তলোয়ার ঘোরাতে শুরু করল হাওয়ায়, এ রকম পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যাওয়ার কোনো মনোভাব দেখালাম না আমি। বরং একটা বিদ্ঘুটে এক্সপ্রেশন দিয়ে, সোজা হেঁটে মাছের দোকানটি পেরিয়ে গেলাম; ওদের পার হয়ে যাওয়ার সময়ও ওরা আর কিছুই করল না। ফলে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
এর পরপরই আমার মাথার কাছে একটা বিপজ্জনক শোঁ-শোঁ শব্দ টের পেলাম। মাথায় কাছে হাতটা যে-ই-না নিলাম, আঘাতটা তখনই এসে লাগল। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম, শিলাবৃষ্টির মতো অগুনতি পাথর ধেয়ে আসছে আমার দিকে। বালকগুলো নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে আমার দিকে পাথর ছুড়ে মারছিল। তাদের এই নির্বাক থাকা আমাকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল।
প্রথমে ভেবেছিলাম, দৌড়ে পালাব; কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, যদি তা করি, তাহলে আমার বেচারা বাঁশের তলোয়ারটি অপমানের লজ্জায় মুষড়ে যাবে। এ কথা মাথায় আসতেই, বাঁশের তলোয়ারটি হাতে নিয়ে, ওদের চোখের সামনে ঘোরাতে লাগলাম। কিন্তু যেহেতু আমার কেন্দো পোশাকটিতে আটকে গিয়েছিল তলোয়ারটির শেষ মাথা, ফলে যথেষ্ট ভালোভাবে ঘোরাতে পারলাম না। তবু এই বালকেরা আমার প্রতিটি মুভকে তাদের জন্য একেকটি হুমকি হিসেবেই গণ্য করল, এবং একে অপরের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে বলতে, নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। আমিও সমস্ত শক্তি দিয়ে, নিজের তলোয়ারটি দিয়ে করতে থাকলাম পাল্টা আঘাত। কেন্দো পোশাকটি ছাড়িয়ে যেতেই, তলোয়ারটি হলে পড়ল হালকা। আর একবার চিৎকার করে উঠলেও, আমার প্রতিরোধ দেখে আতঙ্কে ওদের কণ্ঠ আবারও চুপসে গেল।
নিজের হালকা হয়ে যাওয়া তলোয়ারটি সজোরে ধরে, চিৎকার করে ওঠলাম, ‘শয়তান!’ [‘সামনে আয়’], কিংবা ‘কোতে!’ [‘লড়াই কর!’] কিংবা ‘দেখি’ [‘কত সাহস তোদের!’], এবং এ রকম আরও যা যা শব্দ শিখেছিলাম কেন্দো পাঠশালায়; আর বাঁশের তলোয়ার নিয়ে ওদের দিকে ধেয়ে গেলাম আমি। কী এক কারণে ওরা আমাকে ঘিরে ধরেনি; বরং এই সাত-কি-আটটি ছেলে একত্রে সামনে থেকে আক্রমণ করছিল। নিজেদের অস্ত্র বাতাসে উন্মত্তভাবে ঘোরাতে ঘোরাতে সামনে এসেছিল তারা, ফলে পেছনে নজর রাখতে হয়নি আমাকে। ওদের এই অগুণতি হাতগুলো বাতাসে সুদৃশ্যভাবে প্রদর্শিত হলেও, ওদের স্রেফ এপাশ-ওপাশ লম্ফঝম্ফই সার হওয়ায় ব্যাপারটি সহজ হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। মনে পড়ে, এ রকম বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তা যতদ্রুত সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ারই পক্ষপাতি আমি; ফলে এবারও পাশ কাটালাম, এবং তা করতে আমার জন্য অশেষ সুযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখন।
অবশেষে দৌড়ে মাছের দোকানটির ভেতর পালিয়ে গেল ওরা। দোকানের মালিকটি, মাছ ওঠানো-নামানোর কাজে ব্যবহারকৃত একটি অতিকায় খুঁটি হাতে নিয়ে, ভেতর থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলেন। তখন আমি তলোয়ার লড়াইয়ের সময় লাথি মেরে দূরে ফেলে দেওয়া কাঠের খড়মগুলো টুকিয়ে নিয়ে, এক দৌড়ে পালিয়ে এলাম সেখান থেকে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, নর্দমার ময়লা পানি ভরা একটা সরু গলি ধরে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম আমি। নোংরা গন্ধে ভরা ময়লা পানি থেকে নিজেকে বাঁচাতে, লাফিয়ে লাফিয়ে, আঁকাবাঁকা হয়ে ছুটেছিলাম। এক দৌড়ে সেই গলিটির শেষ সীমানায় পৌঁছে, তারপর থেমেছি; আর পায়ে গলিয়েছি খড়ম। আমার কেন্দো পোশাকটির ভাগ্যে ঠিক কী জুটেছিল, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না আমার। সেটি সেই লড়াইয়ের শত্রুপক্ষের বিদ্বেষের বলিই হয়েছিল হয়তো-বা!
এ ঘটনার কথা আমি শুধু মাকেই বলেছিলাম। এ কথা আসলে কাউকে বলতে চাইনি; কিন্তু কেন্দো পোশাকটি হারিয়ে ফেলেছিলাম বলেই মাকে বলতেই হলো। এ কাহিনী শুনে, মা মুখে কিছুই বললেন না; বরং উঠে গিয়ে আলমারি থেকে বের করে এনে দিলেন ভাইয়ার কেন্দো পোশাকটি—যেটি তিনি আর ব্যবহার করতেন না। তারপর পাথরের আঘাতে ক্ষত হয়ে যাওয়া আমার মাথাটি ধুয়ে দিলেন মা, আর ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন মলম। শরীরের অন্য কোথাও কোনো আঘাত পাইনি আমি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে, আমার মাথায় পাথরের আঘাতের একটি ক্ষতচিহ্ন স্থায়ী হয়ে রয়েই গেছে।
[নিজের বেঁধে রাখা কেন্দো পোশাক ও কাঠের উঁচু খড়মের কথা যখন লিখছি, তখন আচমকাই একটি উপলব্ধি হলো আমার। আসলে অবচেতনভাবেই, নিজের প্রথম সিনেমা ‘সুগাতা সানশিরো’তে এই অবজেক্টগুলো ব্যবহার করেছি আমি—যখন জুডো খেলার প্রতি নিজের জীবন নিবেদন করার নতুন প্রত্যয়ে পৌঁছে সানশিরো, তখনকার ভিজুয়্যাল ডিভাইস হিসেবে। হয়তো স্মৃতির শক্তিটিই আমার ভেতর এই কল্পনার শক্তিটির উদ্রেক ঘটিয়েছিল।]
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, ওচিয়াই ফেন্সিং স্কুলে আসা-যাওয়ার পথটি আমি খানিকটা বদলে নিয়েছি। সেই মাছের দোকানটির সামনে দিয়ে যেতাম না আর কখনোই। তবে তার মানে এই নয়, আমি এইসব বজ্জাত বালককে ভয় পেয়েছিলাম। বরং স্রেফ চাইনি, মাছের দোকানটির মালিক আরও একবার হাতে খুঁটি নিয়ে দৌড়ে আসুন।
কোনো-না-কোনো সময় উয়েকুসাকে এ ঘটনার কথা নিশ্চয়ই শুনিয়েছিলাম, তবে সে কথা এখন আর ওর মনে নেই। বুড়ো লম্পটের মতো সে শুধু নারীদের কথাই মনে রাখতে পেরেছে—এমন অভিযোগে ওকে আমি অভিযুক্ত করায়, ও অবশ্য তীব্রভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে! ঘটনা হলো, এই আদুরে বালকটি—যাকে কিনা এক ঘুষিতেই কুপোকাত করে ফেলা সম্ভব, সে বস্তুতপক্ষে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো জানার পরে সত্যিকারের এক সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। আমরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম, কুসেয়ামা পর্বতের আরেকটি প্রাইমারি স্কুলের কিছু ছাত্রের সঙ্গে একটা লড়াই বেঁধেছিল। সেই শত্রুদের ঘাঁটি ছিল একটা পাহাড় চূড়ায়; এবং আমাদের দিকে পাথর ও নোংরা মাটির ঢেলার বর্ষণ ফলিয়েছিল তারা। পাহাড়ে ওঠার রাস্তার খাঁজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়ে, সেই আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিলাম আমরা। আমি যখন ঠিক করলাম, শত্রুদের পেছনে গোপনে কয়েকজনকে পাঠিয়ে দেওয়া যাক, তখনই উয়েকুসা আচমকাই চিৎকার করে কিছু একটা বলে পাহাড়টির দিকে ছুটে গেল; ভীষণ অদূরদর্শী কাণ্ড ঘটিয়েছিল সে সেটি।
দলের সবচেয়ে দুর্বল মানুষটিই যখন একা একা শত্রুদের আক্রমণ করতে ছুটে যাবে, তখন আর কী করার থাকবে আপনার? তার ওপর পাহাড়টি এতটাই খাড়া ছিল যে, এভাবে দৌড়ে ওঠা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। লালমাটির কাদায় ঢাকা, একেবারেই খাড়া এই পিচ্ছিল পাহাড়ে এক পা এগোলে দুই পা পিছলে পড়া অনিবার্য। তবু ‘নির্ভীক’ উয়েকুসা শত্রুদের সেই নোংরা-মাটির দলা ও পাথর বর্ষণের মধ্যেও ওদের দিকে ছুটে গেল। যথারীতি ওর মাথায় আঘাত হানল বিশাল এক পাথর, আর গড়িয়ে আগের গর্তেই নেমে এলো বেচারা আবার।
সাহায্য করার জন্য আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম, মাটিতে টানটান হয়ে শুয়ে আছে সে, মুখ হাঁ-করা, আর চোখ দুটো আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে আছে। ওকে আমি নির্ভীক নায়ক বলে ডাকতে পারলেই খুশি হতাম, কিন্তু সততার সঙ্গে আমি শুধু এ কথাই বলতে পারি—খুব বিপদের মধ্যে তখন পড়ে গিয়েছিল সে। ঘুরে তাকাতেই দেখলাম, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, বিভীষিকাময় মুখভঙ্গিমা নিয়ে, আমারই দিকে তাকিয়ে আছে শত্রুদলের সবাই। উয়েকুসার শায়িত শরীরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ভাবছিলাম, কী করে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে পারব।
উয়েকুসা ও কুসেয়ামা পর্বত নিয়ে আরেকটি কাহিনী শোনানো যাক। এক সন্ধ্যায় কুসেয়ামা পর্বতের চূড়ায় একা একা দাঁড়িয়ে ছিল উয়েকুসা। ওর বয়স তখন ১৬ বছর; বিশেষ এক ছাত্রীর কাছে একটি প্রেমপত্র লিখেছিল সে, এবং মেয়েটির জবাবের অপেক্ষা করছিল। কুসেয়ামার চূড়ায় উঠে গিয়ে, নরকের অধিপতির প্রতি নিবেদিত মন্দির—এম্মা-দো’র দিকে তাকিয়ে ছিল সে—যদি ঢালুপথে মেয়েটির কোনো চিহ্ন দেখা যায়! কিন্তু নির্ধারিত সময়ে মেয়েটির দেখা মেলেনি। ফলে আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো সে। দশ মিনিট কেটে গেলে, আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করার কথা যখনই ভাবছিল, তখনই মাথা ঘুরিয়ে অন্ধকারের ভেতর একটা দেহাবয়বের দেখা পেল। ‘এই তো, সে চলে এসেছে’—এ কথা ভাবল, এবং ওর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সেই দেহাবয়বটির দিকে এগিয়ে গেল সে, আর কাছে দিয়ে দেখল—মানুষটির মুখে দাঁড়ি!
উয়েকুসার ভাষ্যমতে, সেই মুহূর্তে ‘আমি সাহস হারাইনি। দৌড়ে পালিয়ে না গিয়ে বরং লোকটির মুখোমুখি হয়েছিলাম।’ লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি তোমার লেখা?’ উয়েকুসার লেখা প্রেমপত্রটি তিনি সামনে মেলে ধরলেন। জবাবের অপেক্ষা না করেই তিনি বলে গেলেন, ‘আমি মেয়েটির বাবা’, এবং উয়েকুসার হাতে নিজের নেম-কার্ড তুলে দিলেন। কার্ডে লেখা যে জিনিসটি উয়েকুসার চোখে সবার আগে পড়েছিল, তা ছিল—‘পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, বিল্ডিং অ্যান্ড রিপেয়ার সেকশন’।
উয়েকুসা পরে আমাকে বলেছে, যেহেতু সে সাহসী ছিল, ফলে অবিচলভাবে ভদ্রলোকের মুখোমুখি হয়েছে, এবং লোকটির কন্যার প্রতি নিজের অনুভূতির কথা বর্ণনা করেছে; আর সেই অনুভূতি এতই খাঁটি ছিল যে, বিয়েট্রিসের প্রতি মহাকবি দান্তের ভালোবাসার মতোই সুতীব্র আবেগ দিয়ে মেয়েটির বাবার কাছে তা ধৈর্যসহকারে ও সুবিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছিল সে। শুনে আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘তারপর কী হলো?’ উয়েকুসার দাবি, ‘ওর বাবা শেষ পর্যন্ত আমার অনুভূতি বুঝতে পেরেছিলেন।’ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এরপর মেয়েটির ভাগ্যে কী জুটেছিল?’ উয়েকুসার জবাব, ‘তাকে আর কোনোদিনই দেখিনি আমি, তবে আমরা তো তখন স্রেফ বাচ্চা ছিলাম!’ শুনে মনে হলো, আমি বুঝতে পেরেছি; আবার মনে হলো, না, বুঝিনি!
(চলবে)