বায়োডাটা কিংবা জীবনবৃত্তান্তের গল্প

ধোলাইখালের হাজি মিয়ার মোটর গ্যারেজের পেছনে যেখানে ফালান থাকে আজ সকালে সেখানে এসে মামুন ভাই তাকে বলে গেলেন একটা বাসায় ড্রাইভারের দরকার, সে যেন আজই ওখানে যোগযোগ করে।
মামুন ভাই পরোপকারী মানুষ। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের যাবতীয় কাজ করে বেড়ান। অল্পতেই আপন করে নেন সবাইকে। আর এই মামুন ভাইয়ের সাথে ফালানের পরিচয়ও ওই রাস্তাতেই। পরিচয়ের পর যথারীতি গড়ে ওঠে আন্তরিকতা।
কয়েক দিন ধরেই অকৃতদার এই মামুন ভাইকে একটা চাকরির জন্য ধরনা দিয়ে আসছিল ফালান। কাজ বলতে ফালান একমাত্র গাড়ি মেরামত ও ড্রাইভিংটাই পারে। এদিকে ওর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে শেফালি আক্তার। একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত সংসারও পাততে পারছে না তারা। এর ওপর গত কয়েকদিন ধরে শেফালিও ফালানকে বিয়ের জন্য বেশ চাপ দিচ্ছে। এর পেছনে যদিও একটি গুরুতর কারণ আছে। শেফালিদের বস্তির এক বাপের বয়সী গুন্ডামার্কা লোক নাকি তাকে আসতে-যেতে পথ আটকায়, গায়ে হাত দেয়, অশ্লীল প্রস্তাব দেয়- ‘তোরে দেখলেই শইলডা বড় টনটন করে শেপালি। একবার আমার ঘরে আয় না মাগী...’
নারায়ণগঞ্জের এক পোশাক কারখানায় শেলাইয়ের কাজ করে শেফালি। ঘরে তার অসুস্থ মা আর পঙ্গু ছোট ভাই। তার রোজগারেই চলে সংসার। শেফালির ইচ্ছা ফালানকে বিয়ে করে মা-ভাই মিলে একসাথে অন্য কোথাও থাকবে। এই বস্তিতে আর থাকবে না।
ফালানের সাথে শেফালির সাথে পরিচয়টাও হয়েছে একটু ভিন্ন উপায়ে। হাজি মিয়ার গ্যারেজের পেছনের বস্তিতেই থাকে শেফালিরা। অনেকদিন আগে কোনো একদিন দুপুরে গ্যারেজের পিছনে লুঙ্গি তুলে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছিল কিশোর ফালান। খানিকটা দূর থেকে সেটা চোখে পড়ে শেফালির। কিশোরের পুরুষাঙ্গটির দিকে নিষিদ্ধ কৌতূহলে তাকিয়ে ছিল কিশোরী শেফালি। প্রস্রাব শেষ হলে হঠাৎই ফালানের চোখে পড়ে কোনো এক কিশোরী তার প্রস্রাব করা দেখছে দূর থেকে। চোখাচোখি হতেই ফিক করে একটি হাসি দিয়ে দৌড়ে পালায় শেফালি। লজ্জায় ফালানের শ্যামলা গায়ের রং খয়ারি হয়ে যায়। সেই থেকে মেয়েটির সাথে যখনই ফালানের দেখা হয় মেয়েটি ফিক করে হাসি দিয়ে দৌড় দেয়। ফালান লজ্জা পায়। শেফালি আবার হাসি দেয়, ফালান আবার লজ্জা পায়। এভাবে হাসি ও লজ্জায় পরস্পর একাকার হয়ে যায়। গভীর গোপনে কোনো এক সন্ধ্যার আগে গ্যারেজের পিছনে ফালান ও শেফালি একে অপরকে আলিঙ্গন করে দীর্ঘ চুমু খায়।
অভাব অনেক, কিন্তু ফালান ও শেফালির মধ্যকার ভালোবাসার ঘাটতি নেই এক ইঞ্চিও। অল্পতেই খুশি থাকে দুজন। সামর্থের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তারা একে অপরের জন্য কিছু না-কিছু করে। ফালান যে টাকা রোজগার করে তাতে করে সংসার চালানো রীতিমতো অসম্ভব। তাই একটা চাকরি তার খুবই প্রয়োজন।
আজ সকালে মামুন ভাই এসে বললেন- ফালান, এক বাড়িতে তোর জন্য একটা চাকরি পাইছি। তুই আজই গিয়া যোগাযোগ কর- এই নে ঠিকানা।
বিকেলের দিকে ফালান যায় মামুন ভাইয়ের পাঠানো ওই বাড়িতে। বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে। সাহেব খুব নরম মানুষ। এক-দুই কথা জিজ্ঞেস করার পর ফালানকে বলেন- তাহলে কাল থেকেই কাজে লেগে যাও। আর হ্যাঁ, আসার সময় সাথে করে এক কপি বায়োডাটা আর পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি নিয়ে আসবে।
‘বায়োডাটা’ শব্দটি জীবনে এই প্রথম শুনল ফালান। তবে সদ্য হতে যাওয়া কাজের কর্তাব্যক্তিটির সামনে তা বুঝতে দিল না সে। কোনো রকমে শব্দটি মনেমনে আউড়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সোজা গেল মুশকিল আসানকারী মামুন ভাইয়ের কাছে। সব শুনে হেসে মাছি তাড়ানোর মতো করে উনি বলেন- এইডা কোনো ঘটনাই না। যেকোনো ফটোকপির দোকানেই রেডিম্যাট বায়োডাটার ফরম পাবি। ওইডা ফিলাপ কইর্যা নিয়া যাবি। আর স্টুডিওতে গিয়া বলবি পাসপোর্ট সাইস ছবি তুইল্যা দিতে। ব্যস ...
অতঃপর এলাকার এক পরিচিত ফটোকপির দোকানে গিয়ে বায়োডাটা-ফরম চায় ফালান। দোকানদার অবাক হয়ে বলেন- ওইডা দিয়া তুমি কী করবা? চাকরি খুঁজতেছ নাকি?
ফালান লজ্জা-লজ্জা মুখে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। দোকানদার বিষয়টা গুরুত্বের সাথেই নেন। অনেক দিন ধরেই ফালানকে দেখে আসছেন তিনি। কোনো নেশাপানি করে না, কোনো ঝুটঝামেলাতেও থাকে না ফালান। আদাব-কায়দাও ভালো জানে। তাই সেভাবে আন্তরিকতা না থাকলেও এক ধরনের ভালো-লাগা আছে ফালানের প্রতি এলাকার সবারই কমবেশি। তাই ঘরে থাকা রেডিমেড ফরম ফালানকে না দিয়ে বলেন- দাঁড়াও মিয়া, তোমার জন্য একটা সুন্দর দেইখ্যা বায়োডাটা বানাই দেই। -এই বলে দোকানদার কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসেন এবং ফালানকে তাঁর পাশে বসান। দোকানদার বলেন- আগে নাম কও।
ফালান বলে- আমার নাম তো ফালান।
দুর মিয়া, শুধু ফালান কইলে হইব, আগে পরে কিছু নাই? পুরা নাম কও।
ফালান খুব চিন্তায় পড়ে যায়। তার পুরো নাম তো তার জানা নেই। ময়মনসিংহে থাকতে তাকে অনেকে ডাকতো ‘বল্টু’ বলে। নিজের নামের আগে বসানোর মতো একটি শব্দ পেয়ে যায় সে। বলে- বল্টু ফালান। এইবার হয় নাই?
দোকানদার লিখতে লিখতে বললেন, ঠিকাছে, ঠিকাছে, বল্টু ফালান কিন্তু এইডা কোনো নাম হইল? এইবার বাপের নাম কও।
এবারও দারুণ ফ্যাসাদে পড়ে যায় ফালান। তার মা ছিল বেশ্যা। তারপর কোনো একদিন ফাদার রিগান ডি-কস্তা নামের এক পাদ্রি তাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে আসেন তার নিজের আশ্রমে। বছর দুই উনার স্নেহতলেই বেড়ে ওঠে সে। ফাদারের কাছেই তার লেখাপড়ার হাতেখাড়ি। একসময় ফাদার মারা গেলে আশ্রমের অন্যরা বিড়াল তাড়ানোর মতো করে ফালানকে রেখে আসে এক এতিমখানায়। ফালান জানে, ইংরেজিতে ফাদার শব্দের বাংলা অর্থ বাবা। ওইটা তাকে ফাদারই শিখিয়েছিলেন।
তাই দোকানদারের ওই প্রশ্নের উত্তরে সে বলে- বাবার নাম রিগান ডি-কস্তা।
এ শুনে দোকানদার যেন আকাশ থেকে পড়েন। কি কও? আমি তো তোমারে এত দিন মুসলমান ভাবছি, তুমি তো দেহি মিয়া খ্রিস্টান।
এর জবাবে কিছু বলে না ফালান। দোকানদার তারপর মায়ের নাম জানতে চায়।
ফালান যে বেশ্যারই ছেলে তা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। কোনো এক ভোরবেলায় মালতিবালা দাস নামের এক বেশ্যা তাকে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত এক মালগাড়ির বগিতে কুঁড়িয়ে পায়। মালতিবালা নিজের ছেলে কাল্লুর সাথে ফালানকেও মানুষ করে তোলে। ‘ফালান’ নামটি মালতিবালারই দেওয়া। জীবনে মালতিবালাকেই প্রথম ‘মা’ বলে ডেকেছে সে। অতঃপর দোকানদারকে সে বলে- মায়ের নাম মালতিবালা দাস।
নামটি শুনে দোকানদার বেশ মজা পায়। বলেন- বাহ! কও কি, তুমি দেহি হাফ হিন্দু, হাফ খ্রিস্টান।
ফালান আর কথা বাড়ায় না। দোকানদার বলেন- বর্তমান ঠিকানা?
ঠিকানা বলতে সে জানে হাজি মিয়ার গ্যারেজ, ধোলাইখাল, ঢাকা- এইটুকুই।
দোকানদার বলেন- এইডা বললে হইব? ওইখানের কোনো নাম্বার নাই?
ফালান নম্বর বলতে পারে না। দোকানদার তাই লিখতে লিখতে বলেন স্থায়ী ঠিকানা বলো।
ফালানের হা-মুখ দেখে দোকানদার বলেন- এমন একটা ঠিকানা কও যেইডা লরচর হয় না।
ফের বিপাকে পড়ে ফালান। ছোটোবেলায় বড়ো হয়েছে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে। তারপর ফাদারের সাথে চলে আসে সাভারে। ফাদার মারা যাওয়ার পর ঠাঁই হয় জামালপুরের এক এতিমখানায়। সেইখান থেকে পালিয়ে আজ সে হাজি মিয়ার গ্যারেজে আছে অনেকদিন। স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানা বলতে তো এই একটাই তার জানা। ফালান সেটাই বলে, দোকানদার তাই লিখেন।
দোকানদার- মোবাইল নম্বর কত?
ফালানের একটা ভাঙাচোরা মোবাইল ফোনসেট ছিল ঠিকই। কিন্তু গত সপ্তাহে সেটা চুরি হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে নিজের কোনো মোবাইল নম্বর নেই তার। শেফালির অবশ্য আছে, ওটা সে বায়োডাটায় লিখতে চায় না। গত কয়েকদিন ধরেই ভাবছে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড মোবাইল ফোনসেট কিনবে, কিন্তু সেই সামর্থ্যও তার নেই। এমনকি এ জন্য একদিন হাজি মিয়ার কাছে টাকা ধার চেয়ে অপমানিত হয়েছিল ফালান- ভাত খাওয়ার পয়সা নাই, তার আবার হাতি কেনার শখ। যাহ্, টাকা জমাইয়া মোবাইল কিন, ফেলেট (ফ্ল্যাট) কিন গিয়া- যা, আমি টাকা দিবার পারুম না।
ফালানের মুখে এ কথা শুনে রাগে-দুঃখে শেফালি তার নিজের সেটটা দিয়ে দিতে চেয়েছিল, ফালান নেয়নি। এখন পর্যন্ত টাকা জোগার হয়নি, তাই মোবাইল ফোনসেট কেনাও হয়নি।
ওই ঘরটায় তাই লেখা হয়- চুরি গেছে।
দোকানদার- এইবার জন্ম তারিখখান কও।
কোন সালের কত তারিখে ফালান জন্মেছে তার কোথাও কোনো প্রমাণপত্র নেই তার কাছে। নিজের আসল মা-বাবারই যেখানে ঠিক নেই, সেখানে এটা থাকবেই-বা কী করে? তবে ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি আবছা-আবছা মনে ভাসে তার। সময়টা জেনারেল এরশাদের আমল। হালকা, হালকা মনে পড়ে- সেইবার অনেক বন্যা হয়েছিল। তার বছর দুয়েক পর ময়মনসিংহ শহরে মিছিলে গুলি করে দুজন ছাত্রকে মেরে ফেলেছিল পুলিশ। আঙুলে গুনে, দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে, অবশেষে দুইজনে এই মতে উপনীত হয় যে, ফালানের জন্ম ১৯৮৫ সালের কোনো এক সময়।
দোকানদার মজা করে বলেন- তোমার ধর্ম কী লিখবো কও? হাফ হিন্দু, হাফ খ্রিস্টান?
ফালান মনে মনে ভাবে, সে কি হিন্দু, না খ্রিস্টান, নাকি মুসলমান? এতিমখানায় থাকতে কোরান শরিফের বারো পারা পর্যন্ত পড়েছিল সে। একদিন সকালে সেখানকার কেয়ারটেকার তাকে জোর করে মুসলমানিও করে দেয়। টানা এক সপ্তাহ যন্ত্রণায় কাতরেছে ফালান। তারপর একরাতে ট্রেনের ছাদে চেপে পালিয়ে আসে কমলাপুর স্টেশনে। ধর্ম ঘরে তাই লেখা হয়- হিন্দু+খ্রিস্টান+মুসলমান।
‘জাতীয়তা’ শব্দের সাথে পরিচিত নয় ফালান। দোকানদার তাকে বুঝিয়ে দিলে বিষয়টা নিয়ে সে ভাবতে থাকে। বড় হয়ে একবার সে মালতিবালাকে খুঁজতে ময়মনসিংহে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে শুনতে পায় তার মা চলে গেছেন ভারতের সোনাগাছিতে। আর ফাদার রিগানের জন্মভূমি যে ফ্রান্স, তা উনার মুখেই শুনেছে ও। তারপর ফালান বড়ো হয়েছে বাংলাদেশে। তাই তার জাতীয়তা আসলে কী হতে পারে তা বলতে পারে না। দোকানদারকে বলে- জানা নাই। দোকানদারও এ বিষয়ে আর কৌতূহল দেখায় না। টাইপ করতে করতে বলেন- লেখাপড়া কিছু করেছ, নাকি করো নাই?
ফালান ভাবে, ফাদারের কাছে সে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছিল। তারপর এতিমখানায় কোরান শিক্ষা নিয়েছে। বানান করে করে কোনোরকম লিখতে পড়তেও জানে। শেফালিকে কত ভুল বানানে চিঠি লিখেছে সে, আর শেফালিও তারচেয়ে বেশি ভুল শব্দে তার উত্তর দিয়েছে- তার হিসাব নেই কারো। অতঃপর ফরমে লেখা হয়- ক্লাস টু+কোরানের বারো পারা পর্যন্ত খতম।
দোকানদারের এবারের প্রশ্ন- বিয়া করছ?
ফালান লজ্জা পায়। বলে- অর্ধেক।
মজা পেয়ে দোকানদার বলে- এইডা আবার কেমন কথা? অর্ধেক আবার ক্যামনে বিয়া করে? বাপের জন্মে শুনি নাই।
বিষয়টা খুলে বলে ফালান। একজনের সাথে প্রেম আছে তার। ওর কাছেই হৃদয় বন্ধক আছে। শুধু ঘরে তোলা বাকি। ফরমে লেখা হয় তাই- অর্ধেক বিবাহিত।
অবশেষে সম্পন্ন হয় ফালানের বায়োডাটা।
নাম : বল্টু ফালান
পিতা : রিগান ডি কস্তা
মাতা : মালতিবালা দাস
বর্তমান ঠিকানা : হাজি মিয়ার গ্যারেজ, ধোলাইখাল, ঢাকা
স্থায়ী ঠিকানা : ঐ
মোবাইল নম্বর : চুরি গেছে
জন্মতারিখ : ১৯৮৫, (মাস জানা নেই)
ধর্ম : হিন্দু+খ্রিস্টান+মুসলমান
শিক্ষাগত যোগ্যতা : ক্লাস টু + কোরানের বারো পারা পর্যন্ত খতম
বৈবাহিক অবস্থা : অর্ধেক বিবাহিত
সুপারিশ : মামুন ভাই।
দোকানদারের কাছ থেকে বায়োডাটাটি হাতে পেয়ে ফালানের মনে হতে থাকে যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে সে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার কেবলই শেফালির কথা মনে পড়তে থাকে।