রম্য
ড্রইংরুমের দর্শক মাঠে পড়লে যা হয়

প্রথমেই স্বীকার করছি ক্রিকেট বিষয়ে আমার জ্ঞান একেবারে ক অক্ষর গো মাংস। এই কারণেই কেবল নয়, আমি জীবনে গতকালের আগে মাঠে যাইনি আরো নানা কারণে। যেমন ক্রিকেট খেলাটা আমার কাছে বরাবরই টেলিভিশনে দেখার খেলা মনে হয়েছে। আর এই ধারণা তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখক মোস্তফা মামুন। তাঁর একটি বই আছে- ‘গ্যালারির ফুটবল, ড্রইং রুমের ক্রিকেটি’ শিরোনামে। তাই বলে সারা জীবনে একবারও মাঠে যাব না, তা কি হয়? বন্ধু-কলিগ-বসসহ সবাই মাঠে যায়, খেলা দেখে, সেলফি তুলে ফেসবুকে লাইক-কমেন্ট সংগ্রহ করে গৌরবের ভাগিদার হয়। আর খেলাটি যদি হয় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে তবে আর আমি ঘরে বসে খেলা দেখার গৌরব ধরে রাখার চেষ্টা করব কেন? আরো যদি খেলায় বাংলাদেশ ২-০-তে এগিয়ে থাকে, তবে বাংলাওয়াশের অংশীদার হওয়ার সুযোগ পেলে তা হাত ছাড়া করে কোন বেকুবে?
ভারতের সাথে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন মাশরাফি টস্ জিতেও ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মনের মধ্যে একটা কু-ডাক বেজে উঠেছিল। যদিও মুখে সবাইকে বলেছি- আরে নাহ, ভারতকে হারানোর এইটাও একটা ট্যাক্টিস হতে পারে মাশরাফির। ভারত ব্যাট যখন আড়াইশর মতো রান পয়দা করেছে, তখন আমার হাতে এলো দুটো টিকিট। আমার বস্ দিয়েছেন। মাঠে যাওয়ার জন্য আমি মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। সঙ্গী করলাম মাঠে আগে খেলা দেখেছে এমন একজনকে। কারণ আমি তো জীবনে প্রথম যাচ্ছি- মাঠের নিয়ম-কানুন-আকিদা কিছুই জানি না।
বনানী থেকে অফিসের গাড়িতে মিরপুর অঞ্চলে পৌঁছেই আমার মনে হলো মিরপুরে ক্রিকেট খুব জনপ্রিয় নয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রায় ফাঁকা দেখে গেলেও মিরপুরের রাস্তা যেন ব্রেড, তাতে জ্যাম-জেলি মাখানো আছে। শুধু খেতে হবে এমন অবস্থা। দূর থেকে স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইট দেখেই পুলক অনুভব করলাম। গাড়ি ছেড়ে বেশ কিছুদূর হেঁটে গেটে গিয়ে যে বাঁশের চক্করে পড়লাম, তাতে মনে হলো এমন চিপা দিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকেই এত উচ্ছ্বাস মানুষ দেখায় কীভাবে?
আমার সঙ্গীটি বাঁশ পেরিয়ে টিকিট প্রদর্শন করে একটি ঘূর্ণায়মান ফটক পার হলো। আমিও টিকিট বের করলাম কিন্তু চেকার ছেলেটি টিকিট কেন স্ক্যানারে দিচ্ছে না তা বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় আরো দুজন দর্শক আমার পেছনে। তাঁদের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলে তাঁদের আমার আগে লাইনে দাঁড় করিয়ে টিকিটটি স্ক্যানারে ঢুকানো হলো। ঘূর্ণায়মান গেটটি ঘুরতে শুরু করলে আমিসহ ওই তিনজন এক ধাক্কায় গেট পার হলাম। ধাক্কার চোটে বুঝতে পারলাম, আমার সঙ্গে যাঁরা ঢুকলেন তাঁদের টিকিট নেই, নগদ নারায়ণের বিনিময়ে তাঁরা আমার সঙ্গে পুশইন হয়ে খেলা দেখতে ঢুকলেন। আমি আমার সঙ্গীকে ঘটনা বলতে বলতে আরো একটি ফটকের সামনে এসে টিকিট প্রদর্শন করে গ্যালারিতে আরোহনের অনুমতি পেলাম।
আমার ধারণা ছিল, টিকিটে যেহেতু সারি এবং আসন নম্বর দেওয়া আছে তার মানে আমার আসনটি ফাঁকাই থাকবে। কিন্তু কিসের কি। বসার তো জায়গা নেই-ই, দাঁড়ানোর অবস্থাও নেই। এমন অবস্থা কেন হয়েছে প্রশ্নটি নিজেকেই করলাম। আবার উত্তরও পেলাম নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই। নিজের আসন হারানোর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হলো। কারণ আমি তো একা ঢুকিনি। টিকিট ছাড়া আরো দুজনকে নিয়ে ঢুকেছি। এমন ঘটনা যে কেবল আমার বেলায়ই হয়েছে তা নিশ্চয়ই নয়। আমরা যখন আসন হারিয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে শুরু করলাম, ততক্ষণে তামিমের পথ ধরে সৌম্যও সাজঘরে বিশ্রাম নিতে যাচ্ছে। সৌম কীভাবে আউট হলো বুঝতে পারলাম না। এরপর আরো একজন ব্যাটসম্যান এলো। খেললও বোধ হয় ভালোই- কারণ সবাই তখন চিৎকার করে বোতল বাজাচ্ছিল। আমি খেলা দেখব, নাকি দর্শক নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারছিলাম না। দুই ব্যাটসম্যানকে মনে হলো হাজার মাইল দূরে খেলছে। স্ট্যাম্পগুলো ছাগল বাঁধার খুঁটোর চেয়েও ছোট মনে হচ্ছিল। লিটন দাস আর মুশফিক যখন ক্রিজে, তখন কে লিটন আর কে মুশফিক বুঝতে পারছিলাম না। মুশফিক আমার খুব প্রিয় খেলোয়াড়। ও আর আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। মুশফিক আমাদের হলের জুনিয়র ভাই। ক্যাম্পাসে ওর খেলা দেখেছি।
আমি সেই মুশফিককে মাঠে চিনতে পারছিলাম না এই লজ্জার কথা আজ লিখতেও লজ্জা হচ্ছে। মুশফিক আউট হলো, সবার হতাশা দেখে বুঝতে পারলাম। কিন্তু কীভাবে আউট হলো? জানি না। খেলা আরো দূর গড়াল। মাশরাফির মতো লম্বু প্লেয়ার এলো মাঠে, আমার অবস্থা তথৈবচ। কে মাশরাফি কে নাসির? কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারি না, লজ্জা তো আর ব্যাংকে জমা রাখার জিনিস না, তাই না? অনেকে ভাবতে পারেন আমার চোখের জ্যোতি কম। ছোটবেলায় সবুজ শাকসবজি খাইনি, মলা-ঢেলা খাইনি ইত্যাদি ইত্যাদি। মুশফিক আউট হলো, ধরেন আমি টিভিতে খেলা দেখছি-তখন আমাকে ওর আউট হওয়ার দৃশ্যটা কম করে হলেও সাতবার দেখানো হবে, আমার অনিচ্ছা-ইচ্ছা যাই হোক না কেন?
সাব্বির চার মারল, সেই চারগুলোর রিপ্লেও টিভিতে দেখতে পেতাম অনেকবার। মাঠের দিকে তাকিয়ে আমি সাব্বিরের চারের রিপ্লে খুঁজি, পাই না। সাকিব আউট হলো কোন স্ট্যাম্পের কারণে তাও দেখলাম না। এখন আপনারা মাঠবোদ্ধা দর্শক বলতে পারেন- কেন মাঠে তো দুটো জায়ান্ট স্ক্রিন আছেই। সেখানে রিপ্লে দেখানো হয়। আমি আপনাদের বলছি, যদি স্ক্রিনেই দেখব তবে আমার টিভির স্ক্রিনটার দোষ কি?
সাব্বির ৪৩ রান করে আউট হলো নাকি ৮৩? মোট কত রান হলো? চলতি ওভাবে কত রান? দরকারি রানের গড় কত? বর্তমান গড় রান কত? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে আজ আমার চোখের জ্যোতি সত্যিই কমিয়ে এসেছি। জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে তাকাব নাকি মাঠের দিকে? স্ক্রিনের দিকে তাকাতে গিয়ে যে বল মিস হয়ে যায়? আরো বড় সমস্যা আমি মাঠে কোনো ধারা ভাষ্যকারের কণ্ঠ শুনলাম না। প্রথম দিনের খেলায় মুস্তাফিজকে মাত্র একবার ধাক্কা দিয়েছেন ধোনি। কিন্তু দর্শক হিসেবে আমি ধাক্কা খেয়েছি হাজারবার। সব মিলিয়ে জীবনে প্রথমবার স্টেডিয়ামে গিয়ে আমি হতাশ। আর এই হতাশার আগুনে প্রথম ঘৃত দান করেছে মাশরাফি। টসে জিতে ব্যাটিং না নেওয়ার বোকামি করে। না হলে বাংলাওয়াশের স্বাদ পেলে আমার মতো মাঠের নবীন দর্শকের মনে কোনো আক্ষেপই থাকত না। তবে হ্যাঁ, মাঠে গিয়ে বোতল-বাদ্য বাজিয়ে, চিৎকার করে বাঘগুলোকে যে মৃত থেকে জিন্দা করা যায়, তার প্রমাণ আমি মিনিটে মিনিটে পেয়েছি। মাঠের দর্শককে তাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : সাংবাদিক।