কুরোসাওয়া কথা
জোনাকির আলো
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
গ্র্যাজুয়েশন ডে ঘনিয়ে আসছিল। তখনকার দিনে প্রাইমারি স্কুলের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট ছকে এগিয়ে যেত—প্রচলিত রীতি পালন, আচারনিষ্ঠ কাজ, এরপর সবাই হয়ে পড়ত ভাবপ্রবণ। প্রথমে প্রাণঢালা বক্তব্য রাখতেন স্কুলের প্রিন্সিপাল—গ্র্যাজুয়েটদের উন্নত ভবিষ্যতের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা ও আশীর্বাদমাখা। এরপর অতিথিদের মধ্য থেকে একজন তাঁর বক্তব্যে প্রকাশ করতেন খানিকটা তাচ্ছিল্যের বার্তা। আর সবশেষে গ্র্যাজুয়েটিং ক্লাসের প্রতিনিধিত্বকারী দিতেন একটি আনুষ্ঠানিক বয়ান। তারপর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়িয়ে, সব গ্র্যাজুয়েট একসঙ্গে গেয়ে উঠত :
‘শিক্ষকদের উদারতার জয়গান গাইছি আমরা
খুবই সম্মানিত ও ভাগ্যবান মনে করছি নিজেদের...।’
পঞ্চম বর্ষের ছাত্ররা ধরত পরের লাইন :
‘বছরের পর বছর ধরে, ভাইবোন হয়ে ছিলাম আমরা
সামনের দিনগুলোতেও তেমনই থাকব...’
তারপর সবাই একসঙ্গে শেষ করত গান :
‘জোনাকির আলো হয়ে...।’
এ পর্যায়টিতে এসে, ছাত্রীরা কান্নায় ভেঙে পড়ত। আর এর মধ্যেই, গ্র্যাজুয়েটিং ছাত্রদের প্রতিনিধি হয়ে, আমাকে দিতে হলো একটি আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা।
আমার বক্তব্যটি লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং আমাদের শিক্ষক; আমার হাতে সেটি তুলে দিয়ে বলেছিলেন, যেন একটা কাগজে স্পষ্ট করে লিখে নিই, এবং যথাযথভাবে পড়ি। ওই বক্তব্যে সম্পৃক্ত সকল বিষয় নিয়েই কথা ছিল; তবে পড়তে গিয়ে আমার মনে হলো, এ যেন নীতিবাদী কোনো পাঠ্যবইয়েরই অংশ। আমি জানতাম, নিজের প্রকৃত অনুভূতির বিন্দুমাত্রও এ বক্তৃতায় জুড়তে পারব না। শিক্ষকদের উদারতার প্রতি, ছাত্রদের জন্য তাদের আত্মনিবেদনের অলংকারবহুল এই প্রশংসা-বক্তৃতা ছিল বিশেষ রকমের অতিরঞ্জিত; এবং যখন প্রথমবার পড়েছিলাম শিক্ষকটির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন তার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি।
আগেই বলেছি, এই শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না আমার। কী করে তিনি এমন ফালতু কথা বলতে পারলেন তার ‘বিশাল’ উদারতা এবং তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব বলে আমাদের বেদনা প্রসঙ্গে? নিজেকে নিয়ে এইসব স্তুতিমূলক বয়ান তিনি লিখলেন কী করে? আমার মাংসপেশি কুঁকচে আসছিল; তবু তার লেখা খসড়া কপিটি হাতে তুলে, সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বাড়িতে।
জানতাম এটি অতিরঞ্জিত এবং এখানে আমার কিছুই করার নেই, তবু এই বয়ানটি কপি করার জন্য ভালো কাগজ নিয়ে বসে পড়লাম। যখন কপি করছিলাম, ভাইয়া পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। লেখা শেষ হতেই তিনি কাগজটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘দাও তো, দেখি।’ শিক্ষকের লেখা খসড়াটি হাতে তুলে নিয়ে, আমার পাশে দাঁড়িয়েই পড়তে থাকলেন তিনি। আর পড়া শেষ হতেই, সেটিকে ছোট্ট বলের মতো দলা করে, ছুড়ে ফেলে দিলেন রুমের বাইরে। আর নির্দেশ দিলেন, ‘আকিরা, তুমি এটা পড়বে না। আমি লিখে দিচ্ছি।’
ভাবলাম, আইডিয়াটি বেশ ভালো; কিন্তু আমি জানতাম, শিক্ষকটি তার নিজের লেখা বয়ানের একটি পরিষ্কার কপি দেখতে চাইবেন। ভাইয়াকে বোঝালাম, এই পরিস্থিতি থেকে আমার পরিত্রাণ নেই। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে তার লেখা বক্তৃতা কপি করে তাকে দেখিও। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন তুমি আমার লেখা বক্তৃতাটিও সঙ্গে নিয়ে যেও, আর সেটিই পড়ো।’
ভাইয়া একটা একেবারেই ঝাঁঝাল বয়ান লিখেছিলেন। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থার রক্ষণশীলতা ও কঠোরতাকে আক্রমণ করেছিলেন তিনি। এই সিস্টেমের প্রতি যাঁরা অনুগত এবং এতে সম্মানিত বোধ করেন—সেই শিক্ষকদের ভয়ানক বিদ্রূপ করেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন, ‘আজকের এই মুহূর্তের আগপর্যন্ত আমরা, গ্র্যাজুয়েটরা একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর জীবন কাটিয়েছি; সেই শিকল থেকে বের হতে পেরে, এই প্রথমবার আমরা হাসিখুশি স্বপ্ন দেখতে পারছি।’ তখনকার সময় ও বয়সের হিসাবে, এ ছিল একটি বৈপ্লবিক বক্তৃতা। এটি আমার মন-মেজাজ চাঙ্গা করে দিয়েছিল।
দুর্ভাগ্যক্রমে, এটি পড়ার মতো সাহস আমি দেখাতে পারিনি। এ ঘটনা যদি আমার জীবনে এখন ঘটত, আমি নিশ্চিত গোগলের ‘দ্য পাবলিক প্রসিকিউটর’ নাটকটির পর্দা নামার আগমুহূর্তের মতো একটি দৃশ্যের অবতারণা করতে পারতাম। দর্শক সারিতে অন্যদের সঙ্গে সেদিন বাবাও ছিলেন; ফ্রক কোট পরিহিত তাকে একেবারেই সৌম্য লাগছিল। তা ছাড়া আমি মঞ্চে ওঠার আগেই, শিক্ষকটি তাঁর লেখা বক্তৃতা আমাকে উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনাতে বলেছিলেন, তারপরই দিয়েছিলেন অনুমোদন। যদিও কিমোনোর বুকপকেটে লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম ভাইয়ার লেখা বক্তৃতাটি, তবু সেটি বের করে পড়ার কোনো সম্ভাবনা তৈরি করতে পারিনি।
গ্র্যাজুয়েশন সেরেমনির পর আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম, বাবা বললেন, ‘আকিরা, বেশ সুন্দর একটা বক্তব্য তুমি আজকে দিয়েছ।’ এ কথা শুনে ভাইয়া সম্ভবত বুঝে গিয়েছিলেন, কী ঘটেছে। তিনি আমার দিকে তাকালেন, চোখে-মুখে ঘৃণা নিয়ে। লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। আমি একটা কাপুরুষ!
এভাবেই কুরোদা প্রাইমারি স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছিলাম।
(চলবে)