কুরোসাওয়া কথা
১ সেপ্টেম্বর ১৯২৩
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আমার জীবনে এ ছিল এক কালোদিন; কেননা, গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হওয়ার পরের দিন ছিল এটি। বেশির ভাগ ছাত্রের জন্যই এ ছিল স্কুলে আবারও ক্লাস শুরু হওয়ার উচ্ছ্বাসে ভরা একটি দিন। কিন্তু আমার জন্য নয়। কেননা, এটি ছিল দ্বিতীয় সাময়িকী শুরুর অনুষ্ঠানেরও দিন—যে অনুষ্ঠানটি সবসময়ই আমার কাছে বিরক্তিকর লাগত।
সমাবর্তন সভা শেষ হয়ে গেলে, স্কুল থেকে বের হয়ে, কিয়োবাশি অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জাপানের সর্ববৃহৎ বিদেশি বইয়ের দোকান—মারুজেনের উদ্দেশে পা বাড়ালাম আমি। বড় আপু বলে দিয়েছিলেন, তার জন্য যেন একটা ওয়েস্টার্ন-ল্যাঙ্গুয়েজ বই নিয়ে যাই। কিন্তু পৌঁছে দেখলাম, বইয়ের দোকানটি তখনো খোলেনি। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে, বাড়ির পথে পা বাড়ালাম আমি; ভাবলাম, বিকেলে একবার এসে ঢুঁ মেরে যাব।
কে জানত—মাত্র দুই ঘণ্টা পরেই মারুজেন বিল্ডিংটি এত ভয়ানকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে, আর এটির ধ্বংসের ছবি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে মহাপ্রলয়ঙ্কারী কান্তো ভূমিকম্পের নৃশংসতার একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে। আমি ভেবে পাই না, সকালে বইয়ের দোকানটি খোলা থাকলে আমার কী ভাগ্যে কী ঘটত। আপুর বইটি খোঁজার জন্য নিশ্চয়ই দুই ঘণ্টা ব্যয় করতাম না আমি; ফলে মারুজেন বিল্ডিংয়ের ধ্বংসস্তূপের নিচে আমার চাপা পড়ার আশঙ্কা নিশ্চয়ই ছিল না। কিন্তু ভূমিকম্পটির শুরুতে টোকিওর কেন্দ্রভাগ গ্রাস ও ধ্বংস করে ফেলা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডটি থেকে কী করে পালিয়ে বাঁচলাম আমি?
মহাপ্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পটির দিন সকালে আকাশ ছিল মেঘশূন্য। গ্রীষ্মের ঘর্মাক্তময় তাপমাত্রা তখনো প্রত্যেকের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলতে শুরু করেনি; তবে পরিষ্কার নীলাকাশ নির্ভুলভাবে জানান দিচ্ছিল শরতের আগমনীবার্তা। ঘড়িতে তখন ১১টার মতো বাজে; কোনো রকম পূর্ব-সংকেত না দিয়েই, ভয়ঙ্কর এক ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে শুরু করে। আমার হস্তনির্মিত পুচকে, পাখি-আকৃতির বায়ুনির্দেশক-যন্ত্রটিকে মুহূর্তেই ছাদের ওপর উড়িয়ে নিয়ে গেল সে হাওয়া ভূমিকম্পের সঙ্গে এই ঝড়ো বাতাসের সম্পর্ক ঠিক কী—জানি না; তবে মনে পড়ে, বায়ুনির্দেশক-যন্ত্রটিকে নামিয়ে আনার জন্য আমি ছাদের ওপর উঠেছিলাম, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ‘কী আজব!’
ঐতিহাসিক সেই ভূকম্পনটি শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে, আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা—কিয়োবাশিতে আমার প্রতিবেশী এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মেরে, মাত্রই বাড়ি ফিরছিলাম আমি। চলতি পথে ছিল একটি বন্ধকী দোকান। দোকানটির ছায়ায় দাঁড়িয়েই আড্ডা চলছিল আমাদের এবং আমার বাড়ির গেটে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি লালরঙা কোরিয়ান গাভীর দিকে ছুড়ে মারছিলাম নুড়ি পাথর। এই গাভীটি আমাদের প্রতিবেশীর; এটিকে তিনি টোকিওর তৎকালীন প্রান্তিক শহরতলি— হিগাশি নাকানো থেকে শূকরের খামারের জন্য খাবার আনার কাজে, মালবাহী গরুর গাড়িতে ব্যবহার করতেন। আগের রাতে কী এক কারণে তিনি গাভীটি আমাদের আর তাদের—দুই বাড়ির মাঝখানের সরু গলিতে বেঁধে রেখে গেছেন এবং সারাটা রাত এটি অনুচ্চ স্বরে গোঙানোর শব্দ করেছে। এ কারণে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি আমি; আর তাই নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে এই জন্তুটিকে শায়েস্তা করার জন্য ঢিল ছুড়ছিলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে মাটির নিচ থেকে গর্জনের এক ভয়াবহ শব্দ কানে এলো। আমার পায়ে ছিল কাঠের উঁচু খড়ম এবং গাভীটিকে মারার জন্য আমি শরীর নাড়িয়েছিলাম; ফলে বুঝতে পারিনি—মাটি নড়ছে। শুধু চোখে পড়ল—আমার পাশে যে বন্ধুটি দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল, সে আচমকাই উঠে দৌঁড়াচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে থেকে দেখলাম, তার পেছনে দোকানটির দেয়াল টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে আমাদের বরাবর। আমিও ঝটপট উঠে দাঁড়ালাম।
আমার পায়ে উঁচু খড়ম পরা ছিল বলে কম্পমান মাটিতে ভারসাম্য রাখতে পারলাম না; ফলে পা থেকে খুলে, দুই হাতে দুটি খড়ম তুলে নিলাম। গভীর সমুদ্রে নৌকায় থাকা মানুষের মতো, জীবনের মায়ায় একটি টেলিফোনের পুল সজোরে আকড়ে ধরে রাখা আমার বন্ধুটির কাছে ছুটে গেলাম আমি। ওর মতো করে আঁকড়ে ধরলাম পুলটি। পুলটিও তখন পাগলের মতো দুলছিল। বস্তুতপক্ষে সেটির তারগুলো হাজার-হাজার টুকরোয় যাচ্ছিল খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে।
এরপর আমাদের চোখের সামনেই, বন্ধকী দোকানটির পাশে থাকা দুটি গুদামঘর টুকরো-টুকরো হয়ে যেতে লাগল। সেগুলোর ছাদের টাইলস কাঁপতে কাঁপতে, মোটা দেয়ালগুলোর উপর আছড়ে পড়ল। মুহূর্তেই সেগুলোকে মনে হলো কাঠের ফ্রেমের কঙ্কালের মতো। শুধু গুদামঘরগুলোরই এ অবস্থা হলো না। সব বাড়ির ছাদের টাইলস, যেন সেগুলোকে কোনো চালনি দিয়ে চালা হচ্ছে—এমনভাবে, আচমকা নাচতে নাচতে, কাঁপতে কাঁপতে ভেঙে পড়ল। ছাদের মোটা কড়িকাঠগুলো হয়ে পড়ল খোলা।
জাপানি ঘরবাড়িগুলো কতটা ভালোভাবে নির্মাণ করা হয়, এটিই কি তার প্রমাণ নয়? এমন পরিস্থিতিতে ছাদ হয়ে পড়ে হালকা, ফলে বাড়িটি ভেঙে পড়ে না। ভয়ানকভাবে কাঁপতে থাকা টেলিফোন পুলটি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই এ ভাবনাগুলো খেলে যাচ্ছিল আমার মাথায়। তার মানে এই নয়, আমি শান্ত কিংবা নিশ্চল ছিলাম। মানুষমাত্রই তো মজার প্রাণী; তারা যখন ভীষণ চমকে যায়, তখনও তাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ সম্পূর্ণই আজব রকমের শান্ত হয়ে রয় এবং ভাবতে থাকে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক কোনো কিছু। কিন্তু আমার বেচারা মস্তিষ্ক, যেটি কি না এই মুহূর্তে জাপানি গৃহস্থ স্থাপত্যশৈলী এবং ভূমিকম্পের হাত থেকে সেগুলোর নিজেদের প্রতিরোধক্ষমতা নিয়ে ভাবছিল, তো পরমুহূর্তেই নিজের পরিবারের দুশ্চিন্তায় হয়ে পড়ল উদ্বিগ্ন। ফলে বিপজ্জনক এক দৌঁড় দিলাম আমি— বাড়ির উদ্দেশে।
গেটটির ছাদের অর্ধেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে ঠিকই, তবু এটি কোনোদিকে না সরে নিখাদ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু গেট থেকে আমাদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত সর্বত্রই, আরেকদিকের বিল্ডিংগুলো থেকে পড়া ছাদের টাইলসের ধ্বংসস্তূপের একটি পাহাড় যেন আটকে দিয়েছে পথ। ঘরে ঢোকার সদর দরজাটি আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম না। বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই মারা গেছে!
আজব ব্যাপার হলো, এই অনুভূতিটি মুহূর্তেই আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল শুধু শোকেই নয়, বরং গভীরতর এক সমর্পণবোধে। পরমুহূর্তেই মনে হলো, এই পৃথিবীতে শুধু আমিই একা টিকে আছি। কী করা যায়—উদ্ভ্রান্তের মতো ভাবতে ভাবতে, আর চারপাশে তাকাতে তাকাতে দেখলাম, টেলিফোন পুলে যে বন্ধুকে ফেলে এসেছিলাম, সে তার পরিবারের সবার সঙ্গে, নিজেদের বাড়ির বাইরে এসে চিৎকার করে কাঁদছে। রাস্তার একেবারেই মাঝখানে এসে, দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে তারা। এ অবস্থায় আমার আর করার তেমন কিছুই নেই—এমনটা ভাবতে ভাবতে, ঠিক করলাম, আমি আমার বন্ধুটির সঙ্গেই থাকব, তাই ওদের দিকে হাঁটা ধরলাম।
আমাকে দেখামাত্রই, আমার বন্ধুর বাবা আমাকে কিছু একটা বলতে চাইলেন, কিন্তু তারপর আচমকাই চুপ মেরে গেলেন। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে, আমাদের বাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তার চাহনি ধরে তাকিয়ে, আমি ঘুরে গেলাম এবং পেছনে তাকালাম। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে আমার পরিবারের সবাই। এক দৌড়ে ছুটে গেলাম আমি। যাদের এতক্ষণ মৃত ভেবেছিলাম, তারা শুধু নিরাপদেই নয়, বরং আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল বলেই মনে হলো। তাদের দিকে ছুটে যেতে যেতে খেয়াল করলাম, প্রত্যেকের চোখে-মুখেই স্বস্তির আভা।
পাঠক, আপনি হয়তো ভাবছেন, তাদের দিকে ছুটে যেতে যেতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম আমি? না, কাঁদিনি। সত্যিকার অর্থে এক ফোঁটাও কাঁদিনি। কাঁদা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না; কেন না, ভাইয়া আমার ওপর চিল্লাতে শুরু করে দিয়েছিলেন : ‘আকিরা! এ কি অবস্থা করে রেখেছ তোমার? খালি পায়ে হাঁটছ-- কী নোংরা তুমি!’ তাদের দিকে তাকাতেই দেখলাম, বাবা, মা, আপু ও ভাইয়া—সবার পায়ে খড়ম। মুহূর্তেই নিজের পায়ে খড়ম গলিয়ে নিলাম, আর লজ্জা পেয়ে গেলাম খুব। আমার পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে, একমাত্র আমাকেই ভীষণ বেঢপ লাগছিল তখন। বাবা, মা ও বোন—কাউকেই এতটুকু বিচলিত মনে হলো না আমার। আর ভাইয়াকে দেখে মনে হলো, মহাপ্রলয়ঙ্কারী কান্তো ভূমিকম্পের মুখে পড়ে তিনি শুধু শান্তই নন, বরং যেন ব্যাপারটি বেশ উপভোগ করছেন!
(চলবে)