ভাষা ও সাহিত্য
কী কেচ্ছা!

‘আর্যদর্শন’ নামে এক পত্রিকায় ভাদ্র ১২৮৪ সংখ্যায় গ্রামের মেয়েদের (নারীবাদীরা ক্ষমা করবেন, যা পেয়েছি তাই তুলে দিচ্ছি) ‘কুৎসা’ বা কেচ্ছা-অভ্যাস সম্বন্ধে একটি লঘু কথন প্রকাশিত হয়েছিল। তার কিছুটা এখানে তুলে দিই :
‘গ্রীষ্মকালের দীর্ঘদিনে, গৃহকার্য সমুদয় সুসম্পন্ন করিয়া, পাড়ার দশ বাড়ির দশজন, কুটুম্ব সম্পর্কে আগত পাঁচজন, আর বাড়ির কয়েকজন রমণী অপরাহ্নে অন্দর মহলের রোয়াকে বসিয়া বিস্রম্ভালাপ করিতেছেন। ইহাদের অধিকাংশই বিধবা এবং কাহারও বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের ন্যূন নহে। আলুলায়িতকুন্তলাগণ মাথা দেখাইতেছেন, সংমিতকেশা কয়েকজন সেই মাথাগুলি—এক একজন এক একজনের—দেখিতেছেন। কেহ দীপবর্ত্তিকা প্রস্তুতকরণে ব্যাপৃতা, কেহ শিশুর কাঁথা সীবনে ব্যস্তা, কথার উপর কথা পড়িতেছে, নানা কথার আন্দোলন হইতেছে।— ‘অমুকের স্বামী অমুককে ভালোবাসে না, লোকটার স্বভাবচরিত্র বড়ই মন্দ।— ‘ভালোবাসিবেই বা কি? ভালোবাসা তো মুখের কথা নয়, যে লোকের দোষ দিলেই হইল। মাগীর ঐ তো রূপ, গুণের আবার অন্ত নাই; ভয় নাই; মুখে মিষ্ট কথা নাই; কাঠঠোকরা লোককে যেমন সুখ দেয়, আপনিও তেমনি সুখ পায়।’
এ কথার প্রতিক্রিয়ায় যে বাচনটি তৈরি হলো তা এই রকম— ‘যে আপনি ভালো, তাহার জগৎ ভালো। স্বামীর যদি এতই গুণ, তিনি যদি এমনিই ভালো মানুষ, তাহা হইলে কি একটা মেয়ে মানুষের মন নরম করিতে পারেন না, ভালো বাসাইয়া লইতে পারেন না, তাহাকে ভালো করিতে পারেন না? হরগুণ নাই, বরগুণ আছে, পরের বাছার চক্ষের জল না দেখিয়ে জলগ্রহণ করেন না? লজ্জার কথা বলিব কি (এখানে কুচ্ছো কেচ্ছার দিকে যাচ্ছে—প.স.) গুণবান কথায় ক্ষান্ত দেন না, তাঁহার হাতও মধ্যে মধ্যে চলে। আবার ইহার উপর, যদি একদিন শেষ রাত্রের বাড়ি আইসেন তবে দশদিনের মতো অন্তর্ধান; কথার উক্তি করিলেই সর্বনাশ! মরুক মিনসে, গলার দড়িও জোড়ে না!’
আরো অনেক সংলাপ, মন্তব্য ও বিবৃতির পর অজ্ঞাতনামা লেখক সিদ্ধান্ত করেছেন, ‘আবহমানকালে কুৎসা চলিয়া আসিতেছে, অনন্তকালের সঙ্গে কুৎসা চলিবে, কুৎসার প্রতাপ অক্ষুণ্ণ রহুক, কুৎসার জয় হউক।’
কিচ্ছা, কেচ্ছা, কুচ্ছো—বেশ কিছু শব্দ এসে গেছে বাংলা ভাষায়, কোনোটা ফারসি থেকে, কোনোটা সংস্কৃতের। আবার আমরা নিজেদের প্রতিভায় সেগুলোকে ভেঙেচুরে নিজেদের মতো করে নিয়েছি, তাতে দেখুন মানেও বদলে গেছে কী রকম। ‘কিসসা’ যেখানে ছিল নিছক গল্প, ‘সোনাভানের কিসসা’ বা ‘গুনাইবিবির কিসসা’ যেমন, সেখানে ‘কেচ্ছা’ হয়ে গেছে কারো কুকাজ সম্বন্ধে মুখরোচক খবর, কখনো চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে, কখনো কিঞ্চিৎ অবৈধ বিনোদন সৃষ্টির লক্ষ্যে, বলা। ‘কেচ্ছা’ কথাটার আরো অর্থ আছে— ‘বেশ অবাঞ্ছিত আর ঝামেলাঝংকৃত এক ঘটনা’—‘আর বলিসনে, সে এক কেচ্ছা! কথাটা যে অর্থ মাথা তোলে। কিন্তু ‘শব্দঘর’ –এর সম্পাদক নিশ্চয়ই সে নিষ্পাপ অর্থ সম্বন্ধে ততটা উৎসাহী নন। ‘কুৎসা’ আর ‘কুচ্ছো’-তে অর্থের তফাত বেশি নেই, কিন্তু ‘কুচ্ছো’ কথাটার মধ্যে একটা ধিক্কারের সুর আছে, যেন যে কুচ্ছো করে সে কাজটা তত ভালো করে না— এই রকম একটা মহানুভব ভঙ্গি। যাই হোক, ‘কিসসা, কুচ্ছো বাদ দিয়ে, আমাকে এখন কেচ্ছা নিয়ে পড়তে হবে। তাও এখনকার কেচ্ছা হলেও হতো, এখন চারপাশেই নানা রকম কেচ্ছা বিজবিজ করছে, হাতায় করে তুলে নিলেই হলো। কিন্তু সম্পাদক বললেন, ‘সর্বনাশ, আপনি কি বিনে পয়সায় হাজতবাস করতে চান? সেখানে আমাদের সঙ্গী করতে চান! খবরদার ও পথে হাঁটবেন না। এই হতচ্ছাড়া বর্তমানকে গুলি মারুন! অতীত ঘাঁটুন, সেখানে প্রচুর মণিমুক্তা পাবেন, পুলিশের ভয়ও থাকবে না, আমরাও নিশ্চিন্তে ছাপতে পারব। আপনাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইজারা ছেড়ে দিচ্ছি, ইচ্ছমতো চরে খান!’
বলুন তো, এই বুড়ো বয়সে কেচ্ছা ঘাঁটতে কার ভালো লাগে! প্রথমে ভাবলাম, বলে দিই, দূর বাপু, তোমাদের তরুণ বয়স, তোমাদের কেচ্ছা হজম করার উৎসাহ আর শক্তি দুইই আছে, আমার ও সব নেই। আমার মাথার চুলের সঙ্গে তারুণ্য গেছে, কেচ্ছাবিলাসও গেছে। এমনকি নিজের সম্বন্ধে কেচ্ছাকাহিনীর সমুদ্রও পার হয়ে এসেছি, আর এসব ধাষ্টামো ভালো লাগে না। তারপর মাথা ঠান্ডা হলে ভেবে দেখলাম, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি, কাব্য-কবিতা-গল্প-উপন্যাস নাটক পড়েছি—সবই তো, এখন আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি, কেচ্ছায় ভর্তি। সারা পৃথিবীর সাহিত্য হরেক রকমের কেচ্ছায় ছয়লাপ। সেই আড়াই হাজার বছর আগ সোফোক্লেস লিখেছিলেন অয়দিপৌসের মর্মান্তিক কেচ্ছা, যার ধাক্কায় এখনও পৃথিবী টলমল করে ওঠে। গ্রিক দেবদেবীদের রাজত্ব তো স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে বিস্তৃত, দেবরাজ জেউস বা প্রেমের দেবী ভিনাস-আফ্রোদিতি—দুজনেই নিজের নিজের মতো করে কেচ্ছার গুরুদেব গুরুদেবী বললেই হয়। জেউস খার স্ত্রী হেরাকে ফাঁকি দিয়ে অন্য মহিলাদের প্রতি প্রতি ছোঁকছোঁক করেননি? আফ্রোদিতি আরেস নামে দেবতার সঙ্গেই বেকায়দায় দৃশ্যমান (দৃশ্যমতী হবে নাকি?) হয়েছিলেন বলে তাঁর রগচটা স্বামী হেফায়স্তস সে দুজনকে অদৃশ্য সুতোয় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে মজা দেখেননি? এসব লেখার জন্য দার্শনিক প্লাতোন তো কবিদের প্রচুর গালমন্দ করেছেন। আমাদের দেবরাজ ইন্দ্র কি কম যান? অহল্যার সঙ্গে তার ফষ্টিনষ্টি তাঁকে কী বিপদে ফেলেছিল তা কি কারো অজানা? আর প্রাতঃস্মরণীয় শ্রীরামচন্দ্র যে অমন ঘটা করে জননী সীতাকে বনবাস দিলেন, সেও কি প্রজাদের কুচ্ছো-কেচ্ছার জন্য নয়? আমাদের কেষ্টঠাকুরের কীত্তি নিয়ে কেত্তনও হয় একদিকে, আবার এ কথাও তৈরি হয় যে, দেবতার বেলায় লীলাখেলা আর মানুষের বেলায় ‘কেচ্ছা’। আরব্য আর পারস্য উপন্যাস তো কেচ্ছার মহাভারত। মহাভারতের কথায় মনে পড়ল, ধৃতরাষ্ট্র পান্ডু বিদুর থেকে শুরু করে পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতার জন্মও কি বিচ্ছিরি সব কেচ্ছায় আচ্ছন্ন নয়? যাক বাবা, সংস্কৃত নিয়ে আমার কথা বলা সাজে না, ওটা আমি স্নেহাস্পদ করুণাসিন্ধু না নৃসিংহপ্রসাদের জন্য ছেড়ে রাখি।
আচ্ছা, এই বাংলা সাহিত্যের কথাই ধরুন না কেন? বিতর্কিত হোক আর না হোক, পুরোনো বাংলা কবিতার নমুনা যে চর্যাপদ—তা তো কেচ্ছায় ভেসে যাচ্ছে। দিনে বাড়ির বউ কাকের ডাকে ভয় পায়, আর রাত হলেই সে কিনা কামসুখের সন্ধানে যায়। ডোম-ডোমনির কথা না হয় পবিত্র ভ্যালেন্টাইন দিবসের প্রেমের উদাহরণ হিসেবেই ধরলাম, কিন্তু ডোমনির কুঁড়েঘরে এসে উঁকিঝুঁকি দেয় যে ন্যাড়ামাথা টিকিধারী বামুন—সে কি কেচ্ছার নায়ক নয়? শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কেষ্ট তো কেচ্ছাধারীদের গুরু, রাধাকে ইচ্ছেমতো কব্জা করার পর সে তার হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে মথুরাতে পগার পার— আর রাধা বেচারির সে কী আকুল কান্না— শুনে এখনো আমাদের বুক ফেটে যায়। মঙ্গলকাব্যে শিবঠাকুরের মা দুগ্গা বাচীর মতো চমৎকার বউকে ফেলে ‘কোচিন’র ঘরে গিয়ে হামলে পড়া কি বিশাল কেচ্ছা নয়? ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে শিবের বিয়ের সময় সাপ দিয়ে বাঁধা তাঁর বাঘছালের বসন খুলে যাওয়ায় কী কেচ্ছা হয়নি। (‘বিয়ার কালে এয়োর মাঝে হৈল দিগম্বর লো!)? বিদ্যাসুন্দরের গল্প কেচ্ছা নয়? ঊনিশ শতকে নিধুবাবু যে লিখলেন, ‘ননদিনী বোলে নগরে, ডুবেছে রাই রাজনন্দিনী কৃষ্ণকলঙ্ক-সাগরে’—সে কি নিজের কেচ্ছায় বেপরোয়া প্রচার নয়? তাও কি না ‘ননদিনী’কে দায়িত্ব দেওয়া—যে একাই সবকটা দৃশ্যশ্রাব্য মিডিয়ার কাজ করতে পারে।
ঊনবিংশ শতাব্দী কেচ্ছার অক্ষয় ভাণ্ডার, প্যান্ডোরার অফুরন্ত বাক্সো, জাদুসম্রাট পিসি সরকারের ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’র মতো— তার অন্ত নেই, শেষ নেই, দাঁড়ি নেই ফুলস্টপ নেই।
তা সে বড় ঘরের কেচ্ছা হোক, মেজো ঘরের কেচ্ছা হোক, আর ছোটা ঘরের কেচ্ছা হোক।
‘গোলেবকাওলি’ না হয় পুরোনো কেচ্ছা, কিন্তু ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ তো প্রাচীন ধ্রুপদি সাহিত্য নয়। আর বটতলার কথা আর কী বলব, আমি চুল হারাতে হারাতে প্রায় ন্যাড়া হয়ে এসেছি—ন্যাড়ার বটতলায় যাওয়া উচিত না। না, কথাটা বোধ হয় নড়বড়ে স্থবির মাথায় গুলিয়ে ফেলেছি আমি, মনে হচ্ছে ‘বেলতলা’ ছিল বোধ হয় কথাটা, কিন্তু বেলতলার চেয়ে বটতলা কম সমস্যাসংকুল নাকি? বট পাকলে বটগাছে পাখিদের মচ্ছব লেগে যায়, কাজেই তখন বটতলায় যাওয়াও আমাদের মতো ভালোমানুষের পক্ষে বিপজ্জনক। আর বটতলায় ‘এলোকেশী আর তারকেশ্বরের মহান্ত’ ‘সচিত্র বেশ্যাসংগীত’ ইত্যাদি ছাপা হয়েছে, সে বটতলা তো কেচ্ছার তীর্থক্ষেত্র। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ যে ‘সোমপ্রকাশ’-এ লিখেছিলেন, ‘দেশের দোষে হউক, অথবা অভ্যাস দোষে হউক, আমাদিগের দেশের লোকেরা আদিরসপ্রিয়’ —এ কথাটা কেচ্ছাপ্রিয় বাঙালি সম্বন্ধে প্রশংসা না নিন্দা, তা না বুঝে আমরা ক্যাবলাকান্ত হয়ে যাই।
বড় ঘরের কেচ্ছা নিয়ে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা লিখেছেন নকশা আর ‘দূতীবিলাস’ জাতীয় কাব্যে’ মধুসূদন-দীনবন্ধুরা লিখেছেন প্রহসনে, আর বঙ্কিমচন্দ্র ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যোগীন্দ্রনাথ বসুরা লিখেছেন উপন্যাসে। বঙ্কিমচন্দ্র ‘দুর্গেশনন্দিনীতে মুসলমান রাজকন্যা আয়েষাকে হিন্দু রাজকুমার জগৎসিংহের প্রেমে পড়িয়ে যে কেচ্ছা করলেন, তাতে বিলক্ষণ রেগে গেলেন ঔপন্যাসিক ইসমাইল হোসেন সিরাজী, তিনি তাঁর রায়নন্দিনী উপন্যাসে হিন্দু চাঁদ রায়ের মেয়েকে প্রেমে পড়ালেন বীর ইশা খাঁর। আর হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিখের ‘অখণ্ড’ দক্ষিণ এশীয় সমাজের সামনে এই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘এই ব্যাটারা বল্ এটা এখনো তোদের কাছে কেচ্ছা কি না! যে ধর্মেরই হোক, দুটি তরুণ-তরুণীর পরস্পরের প্রতি এই স্বাভাবিক আকাক্সক্ষা-পোষণকে এখনো কেচ্ছা মনে করিস কি না?’ আমরা তো এ নিয়ে এখনো মনস্থির করে উঠতে পারিনি। এ নিয়ে রেগে মাথা গরম করে ফেলে এমন লোকের তো অভাব নেই। সময় বদলায়, পৃথিবী বদলায়, কিন্তু লোকদের রাগ বদলায় না।
কিন্তু এর বাইরেও কত কেচ্ছার কথা লিখে গেছেন নাট্যকার ঔপন্যাসিকেরা সুন্দরী স্ত্রী থাকতে নম্রমুকী বিধবার প্রেমে পড়া বিষবৃক্ষের কেচ্ছা, শৈবলিনীর বাল্যপ্রেমের কেচ্ছা, গোবিন্দলাল-রোহিণীর কেচ্ছা। মধুসূদন লিখেছেন ভক্তবিটেল সমাজপতিদের কেচ্ছা, তিনি আর দীনবন্ধু লিখেছেন বারফটকা নববাবুদের কেচ্ছা। বিচিত্র সব যৌন কেচ্ছা, আর্থিক কেচ্ছা, নেশাগ্রস্তের কেচ্ছা, ভণ্ডামির কেচ্ছা—কোনো কেচ্ছার অভাব নেই। সেই যে বৃহড্ঢক্কানিনাদিত ঊনবিংশ শতাব্দী—রেনেসাঁসের ধামসা-মাদল-কাড়া-নাকাড়ায় যে সমাজ আর সময়ের পরিসরে কানের পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীকে কেচ্ছার রংমহাল বললেও অত্যুক্তি হয় না। কেচ্ছা ছিল গানে, কেচ্ছা ছিল ছড়ায়, কেচ্ছা ছিল পটে হাফটোন-ব্লকে, কেচ্ছা জেলেপাড়ার সং-এ, কেচ্ছা ছিল বাবুদের বৈঠকখানায়, গাঁজা আর গুলির আড্ডায়। বলাই হয়েছিল, ‘বড়লোক মত্তইবে সরাব আফিমেতে, মাজলা লোক মত্ত রবে মদেতে, ছোটলোক মত্ত হবে গাঁজা ভাঙ্গ খাই।’ বাহ রে শতাব্দী! তুমি একই সঙ্গে অমৃত আর বিষের পাত্র তুলে ধরছ সময়ের মুখে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই অন্য মুখের দিকে তাকাতে কেমন ভয় করে। হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, ‘কলিকালে’ মেয়েদের ‘বেয়াদবি’তে নিরতিশয় বিরক্ত এই ‘দোভাষী’ পুঁথির লেখক—
গরিবুল্লাহ কহে আমি কী করিব আর।
কলিকালে আওরতের লিখি সমাচার॥
ফিরিবারে যায় যদি পড়শীর ঘরে।
খছমের গিবত করে সবাকার তরে॥
কবি তার পরে বলেন, ‘খছম বা স্বামীর রোজগারে খায়, আর তারই কিনা গিবত (নিন্দা) করছে এরা? এদের মুখের লাগাম নেই, ‘বৈসে বৈসে খায় নাহি করে কাম।’ সকলেই জানেন যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতো হিন্দু কবিই এই কেচ্ছাপ্রচারে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জানিয়ে দিয়েছেন যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখে ‘হুট বলে বুট পায়ে দিয়ে চুরুট ফুঁকে স্বর্গে যাবে!’
শুনুন এই গানটি :
বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি-কাঁড়ার ঝনঝানি,
খানা খাওয়ার কত মজা
আমরা তার কি জানি?
জানে ঠাকুর কোম্পানি।
ব্যস, দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘কার টেগোর কম্পানি’ সম্বন্ধে গানে ইঙ্গিতে একটু কুচ্ছে বা কেচ্ছা করা হয়ে গেল। এ কেচ্ছা কি অন্যায়? কে বলবে? নিশ্চয়ই সমাজের একদল মানুষের কাছে ওই অভব্য বিলাস আর অতিচার অসহনীয় মনে হয়েছিল, তাই তারা বিদ্রূপ থেকে রেহাই দেয়নি ওই উঁচু মহলের আমোদপ্রমোদকে। শুধু ভ্রষ্টাচারকে নয়, মহত্ত্বকেও ছাড় দেয়নি সমকাল, যে জন্যে ব্রহ্মবাদী রামমোহনকে নিয়ে গান বেঁধেছিল তার শত্রুপক্ষ :
বেটা সুরাই-মেলের কুল,
বেটার জন্ম খানাকুল,
ওং তৎ সৎ বলে বেটা বানিয়েছে ইস্কুল।
নাকি এর মধ্যে কোনো সত্যও ছিল? সুরাই-মেলের কুলে ‘সুরা’র উল্লেখ, রামমোহনের জীবনে নিকি বাইজির অন্তরালবর্তী অবস্থান-এসব নিয়ে সমকাল তাঁকে কেচ্ছা থেকে রেয়াত করেনি।
কেচ্ছা নিয়ে এই হলো এক মুশকিল, তার পেছনে সত্যের কণিকাও থেকে যায়, তখন তাকে রাখতেও পারি না, ফেলতেও পারি না। গল্প-উপন্যাস-নাটক-নক্শার কথা ছেড়ে দিলাম, ধরে নিই সেগুলো সবই কাল্পনিক নরনারীদের নিয়ে লেখা সেসব কেচ্ছা আমাদের গায়ে লাগে না। কিন্তু আসল মানুষের কেচ্ছা যখন আমাদের মুখে এসে ঘুষি মারে? কেশবচন্দ্র সেন নিজে তিন আইন পাস করিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে আটকে দিলেন, কিন্তু যেই কোচবিহার আর ময়ূরভঞ্জের রাজকুমারদের সঙ্গে সম্বন্ধ এলো অমনি নিজের অপ্রাপ্তবয়স্কা দুই মেয়েকে ড্যাং ড্যাং করে তাদের সঙ্গে বিয়ে দিলেন-এ কেচ্ছা নিয়ে আমরা কী করব? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে কেচ্ছাকাহিনী এখন বাজারে খুব খাচ্ছে, তাকে নিয়েই বা আমরা কী করব? কে যাচাই করবে কেচ্ছার সত্যমিথ্যা? কে বন্ধ করবে কেচ্ছাকে নিয়ে ব্যবসা?
ঠাকুরের আসনের গীতা যেমন উইপোকার আক্রমণ থেকে রেহাই পায় না, তেমনই কেচ্ছা কখনো কখনো মহত্ত্বকে রক্তাক্ত করে, আর আমরা যারা সরল- সাদা-কালোয় পৃথিবীকে ভাগ করে দেখতে চাই তারা কেমন দিশেহারা হয়ে যাই।
কোনটাকে রাখব, কোনটাকে ফেলব? নাকি দুটোই মানুষকে আরো বেশি মানুষ বলে চিহ্নিত করে, আমাদের বলে যে, দ্যাখো, বোকার মতো পৃথিবীটাকে অত সরল ভেবে বোসো না। কেচ্ছা আছে বলেই মহৎকে মহৎ বলে চেনা যায়-অন্ধকার না থাকলে আলোর কোনো মহিমা কি আদৌ বোঝা যেত?
(লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় মোহিত কামাল সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা শব্দঘরের পয়লা বৈশাখ, ১৪২২ সংখ্যায়।)