সাহিত্যে দুর্গাপূজা
বাংলা রামায়ণ সৃষ্টিতত্ত্বের পূর্ববর্তী রচিত সাহিত্যকর্মের ইতিহাসে দুর্গোৎসবতত্ত্ব ও প্রাসঙ্গিক প্রায়োগিক বর্ণনা উল্লেখ আছে সুস্পষ্টভাবে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণসহ শাস্ত্রীয় সব গ্রন্থে সাবলীলভাবে বর্ণিত হয়েছে দেবী দুর্গার বহুমুখী উপাসনার রীতি ও পূজা পদ্ধতি। জ্ঞানশক্তি, সম্পদশক্তি সংগ্রাম কৌশল শিক্ষায় আসুরিক শক্তির বিনাস সাধনে সিদ্ধিশক্তির সম্মিলন প্রক্রিয়াও শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলোতে বিধানাকারে অবতীর্ণ বিষয় হিসেবে বিধৃত আছে। পৌরাণিক, ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক এবং সাহিত্যিক বর্ণনার চেতনা থেকে সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীরা শক্তির উৎস চিহ্নিত করে অকৃত্রিম ভালোবাসা, ক্ষমা, সরলতা, পবিত্রতা ও ত্যাগের আদর্শ হিসেবে করে থাকেন দৈবশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গাপূজা-অর্চনা ও আরাধনা।
বৈদিক সাহিত্যেও দুর্গার উল্লেখ আছে। দুর্গাকে ডাকা হয় আদ্যশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা প্রভৃতি নামে। বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যানে দুর্গাপূজার প্রচলন-সম্পর্কিত বিবিধ কিংবদন্তি রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, দুর্গোৎসবের প্রবর্তক স্বয়ং কৃষ্ণ। আদিবৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজার পর মধুকৈটভের ভয়ে দুর্গার আরাধনা করেন ব্রহ্মা। তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেন মহাদেব, ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে সংকটাপন্ন হয়ে। দুর্বাশা মুনির দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র চতুর্থবার দুর্গাপূজা করেন। এরপর থেকে পৃথিবীতে মানবজাতির মধ্যে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু দেবী দুর্গার আরাধনা করেন; এর উল্লেখ আছে দেবীভাগবতপুরাণে।
এদিকে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজা উঠে এসেছে বিভিন্ন রচনায়। দেবী দুর্গা সেখানে কখনো মাতৃরূপে, কখনো শক্তি রূপে, আবার কখনো বা এটিকে দেখা হয়েছে কেবল অনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় :
‘পুতুল পূজা করো না হিন্দু, কাঠ মাটির দিয়ে গড়া
মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, যাই আত্মহারা’
রবীন্দ্রনাথ দেবী দুর্গাকে আনন্দময়ী হিসেবে অভিহিত করে আরাধনা করেছেন মুক্তি ও ভক্তির সঙ্গে। রবীন্দ্র কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটকে এমনকি চিঠিপত্রে উজ্জ্বল আনন্দময় দুর্গোৎসবের অপরূপ বর্ণনা ফুটে উঠেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে বিমলা, সন্দ্বীপ ও নিখিলেশ চরিত্রগুলো দেবী দুর্গার সার্বজনীন সমন্বিতা রূপবৈচিত্র্যপূর্ণ করে সাজিয়েছেন। অন্যদিকে অপূর্ণতা, বিচ্ছিন্নতা, অখণ্ডতাকে মুক্তির পরিপূর্ণ তাৎপর্যে নিপুণভাবে সাহিত্যে প্রবেশ করিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেবী দুর্গাকে নজরুল দেখেছেন, ‘রক্তাম্বরধারিণী রূপে’। গান, কবিতা, উপন্যাস, ছায়াবাণী ছাড়াও প্রীতি, সৌহার্দ্য, সম্ভাষণে শাক্ত পদাবলি রচনা করে মহাকালজয়ী হয়েছেন।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মাইকেল মধুসূদনের কালজয়ী সৃষ্টি। এখানে তিনি দেবী দুর্গাকে কল্পনা করেছেন ‘শশাঙ্কধারিণী রূপে’। বক্ষ বিদীর্ণ করা কিছু ‘সনেট’ রামায়ণ মহাকাব্যকে দুর্গোৎসবের পরিপূর্ণ প্রয়োজন রূপে রূপায়িত করেছেন মধুসূদন। দেবী বিসর্জন ট্র্যাজেডির এক অসাধারণ বর্ণনা দিয়ে মেঘনাদবধ কাব্যকে সমাপ্ত করেছেন তিনি।
‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে,
সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।’
বাংলা সাহিত্যের আরেক নবরূপকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জ্যোতির্ময়ী দেবী দুর্গার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারেননি তিনি। পার্বতী এবং দুর্গা নামে কোমল, কঠিন ও মমতাময়ী আবেগপ্রবণ হৃদয়স্পর্শী চরিত্রায়ণ করে আরাধনায় রূপান্তরিত করেছেন সাহিত্য সৃষ্টিকে। আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিকর্মে দেবী দুর্গার মাতৃমুখী সংস্কৃতি লাবণ্যে অপূর্ব বর্ণনায় আশ্চর্যজনক অভিব্যক্তি সৃষ্টিতে দেখিয়েছেন পারদর্শিতা। দেবী দুর্গাশক্তির সর্বজয়া উত্থানে কৌতূহল ও উৎসাহ সৃষ্টির অনুভূতি প্রভাব বৈরিতার অবসান ঘটিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমাজিক সাহিত্যকর্মে। অপু-দুর্গা, সতু, মালতী, হরিহর, ইন্দির ঠাকুরণ চরিত্রগুলোর শরতের শুভ্র শীতল কোমল ব্রহ্মশক্তির পরিপূর্ণ আরাধনাকে দারিদ্র্য মুক্তির অবলম্বন হিসেবে প্রকাশ করেন বিভূতিভূষণ। এদিকে সংকট উত্তরণের শিক্ষা প্রদানকারী ব্রহ্মময়ী দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা আমাদের বিবর্ণ চলচ্চিত্রে জাগ্রত করেছেন বিভাসিত উপলব্ধি। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’, ‘নৌকাডুবি’, ‘হীরের আংটি’ আর সত্যজিতের কালোত্তীর্ণ সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ আধুনিককালের দেবী দুর্গাপূজাকে ব্যাপকতা লাভ করিয়েছেন বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ মিলনের উৎসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র হিসেবে।