সাখাওয়াত টিপুর মফস্বলের কবিতা
মফস্বলের কবিতা : ১
যে বাড়িতে বক থাকে তারা টাকাওয়ালা হন। টাকা না হলেও অলংকারে ভরা ভবিষ্যৎ। বকগুলো ভালো অলংকারশাস্ত্র বোঝে। তাই তারাও বকধার্মিক।
আমি আর বক ছাড়া আমাদের গ্রামে কেউ নেই! তারা বকবক করে। আমি বলি : ভাষা! তারা ঠোঁট দিয়ে টুক করে মাছ ধরে। আমি বলি : মাৎস্যন্যায়!
বগার বিলের দিকে গেলে আমি একা হয়ে যাই। বলি বক ভাই, এমন ফাঁকানো বিলে তুমি থাক কী করে? বলে : আমার চোখ তো চিলের মতো। আমি বলি : বকানন্দ!
সব মফস্বলের ভাষা বকের ঠোঁটের মতন ধাঁরালো! বক ডাকলেই আমাদের গ্রামে ফুটে ওঠে আলো। এখন শহরে কোনো বক থাকে না। সবাই ধার্মিক। সবাই কেমন বকবক করে, দশদিক।
মার্চ ২০১৪
ঢাকা
মফস্বলের কবিতা : ২
আজ হাটবার। আজ বেগুনের গুণাগুণ নিয়ে বসছে বিচার। আমরা বেগুন চাষি। অকারণে হাসি বারবার। আমরা বেগুন বেচি। অযথা বেগুন খাই। যার কোনো গুণ নাই। তাই বিটি বেগুনের বিচি নিয়ে এত হাহাকার।
আজ বুধবার। আজ পটল হচ্ছেন বিচারক। কখনো তার অটল রূপ দেখিনি। আমরা পটল চিনি। পটল বলেন, চীনা বেগুনের কাঁটা বেশি। তাই স্বাদ বেশি। পোকা খায়। তাই আমরাও পোকা খাই। আমরা সরল মনে বেগুনের গুণ গাই।
পটল তুলনা করেন বিচির। বলেন, আমাদের বিচি বেগুনের চেয়ে বড় এবং অনেক দড়ো। আমরা সহজে ধরে নেই, বেগুনের গুণ কম! বিচি ছোট। রং কালো। তাতে বেগুনের দাম কমেই না একদম।
বেগুন আসামি হওয়ায় আমাদের ওপর খেপে যায়। আমরা বোঝাই। বলি ভাই, তোমরা পটল নিয়ে প্রশ্ন তুলিও না। পটল তুলিলে এই জগতে আর তোমাদের দেখা পাব না।
বেগুনের অকাল মৃত্যুর কথা শুনে আমরা সাংবাদিক গনির কাছে যাই। গনি বলে : কোনো কাজ হবে না এখন। আমাদের মিডিয়ায় এ নিয়ে প্যাকেজ করার সুযোগ সেই। বেগুন পটল তুলিলেও কিচ্ছু তো করার নাই।
হায়, আমরা সংকটে আছি। আমরা বেগুন বেচি। আমরা বেগুন চাষি। অথচ এমন রবির মৌসুমে আমাদের কাছে বেগুনের বিচি নাই। বিটি বেগুনের কাছে আমরা শুধাই : অকাল মৃত্যুর পর ব্র্যাক দেখি বেগুন বিচির অনেক দাম হাকায়।
নভেম্বর ২০১৪
ঢাকা
মফস্বলের কবিতা : ৩
ভোরের শিশির ছাড়া সিমের মর্যাদা কেউ-ই বোঝে না। আমরা জ্ঞানত জানি, শিশির খেয়েই সিমেরা বেঁচে থাকে। তাই আমরা শীতের কথা বলি অনায়সে। রসেবসে সিম! আহা সিম। লতানো কাঠির ওপর জীবন এভাবেই ঝুলে থাকে। আউশ ধানের আলে। উড়ন্ত গাছের ডালে। কীভাবে ঝুলছে সিমের জীবন!
আমার দাদারা চাষা। আব্বারা ক্ষেতমজুর। গরু পোষে! হাল আর সরকারি আল ছাড়া নিজের তেমন জমিজমা নাই। তাতে তারা তিন পদের সিম ফলায়। পদ যাই হোক আব্বা কিন্তু চাষি। চাষ ছাড়া তাদের জীবনে বাস নাই। সিম ফলানোর বাঁশ নাই। তাই বাঁশ কিনতে কিনতে জীবন ইজারা যায়।
লতা সিম দেখতে সুন্দর। এমন লতিয়ে থাকে! কত খাঁজকাটা। এক বিচি পরপর, পরের উত্তল। সামান্য বাতাসে কোমর দোলায়। ততক্ষণ নাচে, যতক্ষণ বায়ু বয়। ভাবি : সিমেরও মুদ্রা আছে ভারী! আব্বা নিরক্ষর। বোঝে না কিছুই। তা নিয়ে দাদার কোনো হাহুতাস নাই। ওই শুধু বলে, বরবটির বাহার এমনই!
সাদা সিম দাম বেশি। কারণ বিদেশি। বড় বড় বিচি। হরিণের মতো রূপচিত্রময়। সাদার সঙ্গে বাদামি, না হয়-- সাদাকালো জেব্রা রূপেরই হয়। কেন যে এমন হয়! তা নিয়ে সকালে মাঠকর্মী এক অস্তিত্ববাদীকে ডাকা হয়। সেও বলে: সাদার তুলনা সাদা। দুনিয়ায় তার তুলনায় অন্যকিছু নাই!
সবুজ সিমেরা দেশি। পাল্লায়ও ধরে বেশি। লাগে বেশি, তাই দাম কম। দাদা তো আদম। তাই সবুজই ভালোবাসে। আব্বা তো অবুঝ! নিরক্ষর মাহফুজ। আমি তো দাদার উত্তরাধুনিক নাতি। মাথায় দিয়েছি ছাতি। আহারে লতানো জীবন দেখলে করে ডর! আর অসীম অভাব দেখি সিমের ভেতর।
ডিসেম্বর ২০১৪
ঢাকা
মফস্বলের কবিতা : ৪
মানুষের জিহ্বার চেয়ে মরিচের অনুভূতি বেশি। ফলে সে নিমিষে সঞ্চারিত হয় কানে! কান লাল হলে আমরা সহজে বুঝি মরিচই সবজির রাজা। মানুষ শাসায়। জল আনে। নাকে-মুখে জল এলে মরিচ দখল করে আমাদের স্মৃতি। স্মৃতি বড় কাহিনীনির্ভর। কোথা থেকে কীভাবে আমরা মরিচ খেতে এলাম। সেও এক বিস্ময়!
নানা স্মৃতি নিয়ে আমরা গনি মিয়ার কাছে যাই। আবার ভাবতে থাকি, যাওয়াযাওয়ি ঠিক কি না? নাকি গনি মিয়া নামে কোনো জাতীয় কৃষক নাই। থাকলে তো থাকতেই পারে, না থাকলে নাই! আমরা হুদাই ভাবি! না ভাবলে নাই। আসলে স্মৃতির কোনো আব্বা-আম্মা নাই। কান লাল হলে মনে হয় মরিচ মোদের ভাই।
মরিচ সবুজ। পাকলেই লাল। চকচক করে। খুব তৈলাক্ত সুন্দর। আমরা ভাবতে থাকি গনি মিয়াও কি মরিচের মতো সুন্দর, নাকি তার বৌ মরিচের মতো লাল। আমরা ফ্রয়েডের কাছে যাই। সেও বলে, বাহ্যিক রূপের কোনো বিশ্লেষণ নাই। ফ্রয়েডের কথায় আমরা চোখকে সন্দেহ করি। মনে মনে বলি : কেন দুই চোখে এক বস্তু দেখা যায়?
আমার মা মরিচের ভাষা বোঝে। আম্মা রন্ধন শিল্পের দার্শনিক। আমরা আম্মাকে বলি : মরিচ কি জীবনের মতো বাঁকা হয়? আম্মা বলে : শিল-পাটা ছাড়া মরিচের ভাষা কীভাবে বোঝাই! জীবন আসলে পিষে যাওয়া মরিচ। পিষা যত সূক্ষ্ম হয়, জীবন তত মিহিন। না হলে জীবন টকটকে লাল মরিচের শিং!
মাঝে মাঝে কাঁচা মরিচের জন্য দুঃখ হয়। কত না সরলভাবে খেয়ে ফেলি। তবে ধানি মরিচের ন্যায় আমরাও কি পাছা উপর দিকে রেখে ভাবি। নাকি ভাবতে ভাবতে বোম্বাইয়া মরিচের সুবাসে মোহিত হই! মরিচ লাঁকার মতো বাঁকা! গোল মরিচের মতো কালো। ভেতরে সফেদ! আমরা স্মৃতিতে খুব রিচ। হায় আমাদের স্মৃতি যেন পাহাড়ি মরিচ!
মার্চ ২০১৪
ঢাকা