দেশে দেশে শহীদ মিনার
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের অনুরূপ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব রেখে বক্তব্য রাখেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ। সেসময় এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি ‘পাকিস্তানের ভাষাসমস্যা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধও লিখেন। সেই রচনায় তিনি মতপ্রকাশ করেন— বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে তা হবে রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর। ড. শহীদুল্লাহ্’র এ বক্তব্য সেসময়ে বাঙালির প্রাণকে উদ্দীপ্ত করে। এমনকি সমকালীন অন্য ভাষাভাষী শিক্ষিত-সমাজকেও উজ্জীবিত করতে নিবন্ধটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ভারতের সাপ্তাহিক ‘কমরেড’ পত্রিকায়। ‘দি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেমস অব পাকিস্তান’ নামে কমরেড পত্রিকায় তা প্রকাশ পায় ১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট। যার ফলে ভাষা আন্দোলনের উৎস-পুরুষ বলে মর্যাদা দেওয়া হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে। পাকিস্তানের প্রাক্কালে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবি উত্থাপিত হয়, তা প্রথম প্রতিবাদের মুখে পড়ে পণ্ডিত এ ব্যক্তির লেখনিতে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তৎকালীন শাসকের দেওয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একদল সাহসী-প্রাণ ভাষার দাবিতে আত্মদান করেন। সেই মহৎ-প্রাণদের অমর করতে রাখতে নির্মাণ করা হয় স্মৃতির মিনার।
মূলত শহীদ মিনার হলো ভাষা আন্দোলনের শহীদ এবং শহীদ দিবসের স্মৃত্মিরক্ষক স্থাপত্য। এ মিনার কেবল শিল্পীর নির্মিত কোনো ভাস্কর্যমাত্র নয়; বরং এটি বাংলাদেশি, বাংলাভাষী মানুষের চেতনার প্রতীক, বাঙালির সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনে এক প্রাণবন্ত সত্তা ও প্রেরণার উৎস। ১৯৫২ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলবাসী শিক্ষার্থীদের এক রাতের শ্রমে ১০ ফুট উঁচু, ৬ ফুট চওড়া যে বেদির শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় দৃপ্ত গৌরবে, তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম শহীদ মিনার। যদিও সেই মিনারটির আয়ু ছিল মাত্র আড়াই দিন। তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসক-পুষ্ট পুলিশ বাহিনী ভেঙে গুড়িয়ে দেয় এটিকে। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি শেষ বিকেলের দিকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঘটায় এ অঘটন। এমনকি মাটি খুঁড়ে মিনারের শেষ ইটটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক, ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের ‘শহীদ মিনার’ শীর্ষক লেখা থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করা যায়—
“শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি একুশের আন্দোলনে এক মাইল ফলক। আড়াই দিনের আয়ু দিয়ে বিলুপ্ত শহীদ মিনার মানুষের প্রাণের মিনার হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে সংগ্রামের, প্রতিবাদের প্রেরণা। ওই বায়ান্ন সালেই আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে রাজশাহীসহ একাধিক শহরেও গড়ে ওঠে শহীদ মিনার। কিন্তু ওরা সবাই মুসলিম লীগ সরকারের আক্রমণের শিকার, কেউ স্থায়িত্ব পায়নি। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ ঘটিয়ে তবু ১৯৫৩ সাল থেকে শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে দেশের সর্বত্র শিক্ষায়তন প্রাঙ্গণে তৈরি হতে থাকে ছোট বড় শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে সূর্যহীন ভোরে খালিপায়ে প্রভাতফেরি, কণ্ঠে একুশের গান। দেশময় শহীদ মিনারের মিনিয়েচার। এই প্রেরণার পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গঠন।”
দীর্ঘ ৪৭ বছর পর রফিকুল ইসলাম নামের একজন কানাডা প্রবাসীর একান্ত ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা লাভ করে। ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯ সাল— সেই ঐতিহাসিক দিন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় জাতিসংঘের সাধারণ সভায়। অতঃপর দিনকে স্বীকৃতি দিতে ১৮৮টি দেশ তাদের নীতিগত সমর্থন জানায়। এ প্রস্তাবে কোনো দেশই কোনোরকম বিরোধিতা করেনি, এমনকি পাকিস্তানও নয়। সবশেষে সে সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ২১ শে ফেব্রুয়ারি গৃহীত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। তারপর থেকে জাতীয় পরিসর থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পালিত হতে থাকে দিনটি। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন শহীদ মিনার ঠাঁই করে নিয়েছে ভারত, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা, প্যারিসেও।
যুক্তরাজ্যে শহীদ মিনার
বাংলাদেশের বাইরে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয় লন্ডনে। গ্রেট মেনচেস্টারের ওল্ডহ্যামের ওয়েস্টহুড নেবারহুডে তৈরি হয়েছে এ মিনার। ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর সেখানকার ‘বাংলাদেশি কালচারাল অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন ওল্ডহ্যাম’ সেদেশে শহীদ মিনার নির্মাণ করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সেই সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা কামাল হোসেন বলেন— “That the celebrations of the language Martyrs on 21 February (Ekushe) are a central meeting for Bengali from all across the north of England.” লন্ডনে নির্মিত হয়েছে ৩টি স্থায়ী শহীদ মিনার। বাকি দুটি হলো আলতাব আলী পার্কে যা স্থাপিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এবং লুটন শহরে যা স্থাপিত হয় ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট। (তথ্যসূত্র : বিলেতের মাটিতে একুশে ফেব্রুয়ারি ও বাংলা ভাষার প্রসার, তারেক চৌধুরী, দৈনিক আমার দেশ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০, ঢাকা)।
ওল্ডহাম ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। লন্ডন এবং বার্মিংহামের পর এই ওল্ডহামেই সর্বাধিক বাঙালির বসবাস। সেখানকার কিছু বাঙালি যুবক ১৯৯০ সালে ওল্ডহামে স্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য কাউন্সিলের কাছে আবেদন করে। সমকালে ওল্ডহামের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও এ দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। তখনকার ওল্ডহাম কাউন্সিলের বাঙালি কাউন্সিলার আবদুল জব্বারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওল্ডহাম কাউন্সিল সেখানে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের লক্ষ্যে ২৫ হাজার পাউন্ড ও প্রয়োজনীয় জায়গা প্রদান করেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত ওল্ডহামের এ শহীদ মিনারটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বাইরে স্থায়ীভাবে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার এটি।
১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডন শহরের অ্যাডলার স্ট্রিটে অবস্থিত হুয়াইট চার্চ লেন এবং হুইটচ্যাপেল হাই স্ট্রিটের পার্শ্ববর্তী আলতাব আলী পার্কে ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রিপ্লিকা তৈরি করা হয়। পূর্বে এ পার্কটির নাম ছিল সেন্ট মেরিস পার্ক। একজন প্রবাসী বাঙালি আলতাব আলীর স্মরণে পরবর্তী সময়ে এ পার্কটির নামকরণ করা হয় আলতাব আলী পার্ক। এ পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় শহীদ মিনারটির ছোট রেপ্লিকা অবস্থিত। মূলত ৪ মে ১৯৭৮ সালে প্রবাসী বাঙালি আলতাব আলী কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বর্ণবাদী হামলায় নিহত হন। তারপর সে এক ইতিহাস। পূর্ব লন্ডনের রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। আলতাব আলীর কফিনের পেছনে পেছনে হেঁটে যায় তারা। সে ছিল এক সংহতি, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিশাল ঐক্য। তারই স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত হয় এ শহীদ মিনারে রিপ্লিকা। ভাষা নয়; বর্ণবাদের কারণে নিহত কোনো শহীদের উদ্দেশে এটি পৃথিবীর প্রথম কোনো বাঙালির স্মৃতিসৌধ।
জাপানে শহীদ মিনার
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকার নির্মিত এটি প্রথম শহীদ মিনার। এর আয়তন উচ্চতায় ২.৬ মিটার এবং প্রস্থে ২.৫ মিটার। ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মাপের সাথে মিলিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ স্টিল ফ্রেমে তৈরি এটি। জাপানের সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র, পার্ক প্রাঙ্গণের টোকিও মেট্রোপোলিটন আর্ট স্পেস-এর ইকেবুকুরো নিশিগুচি পার্কের পশ্চিম গেইটে এটি অবস্থিত। এ পার্কে শহীদ মিনার আছে বলে প্রবাসীরা পার্কটিকে নাম দিয়েছে ‘শহীদ মিনার পার্ক’। পার্কটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত।
সর্বপ্রথম তোশিমা সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে শহীদ মিনার তৈরি প্রস্তাব করেন জাপান প্রবাসী গবেষক ও চিকিৎসক ড. শেখ আলীমুজ্জামান, যা সমর্থন করেন তৎকালীন তোশিমা সিটি কর্তৃপক্ষের প্রধান ড. ওসামু ওতসুরো। পরবর্তীকালে ২০০৫ সালে জাপান বাংলাদেশ সোসাইটি উদ্যোগে আয়োজিত বৈশাখী মেলা কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। এ সমর্থনে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সরকার। ১২ জুলাই ২০০৫ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৬ জুলাই ২০০৬ সালে সপ্তম টোকিও বৈশাখী মেলায় এটি উদ্বোধন করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন জাপানের তৎকালীন পরিবেশ মন্ত্রী উরিকো কোইকি (Yuriko Koike)।
এই শহীদ মিনারটির সামনে একটি সাদা ফলকে জাপানি, ইংরেজি ও বাংলা—এই তিন ভাষায় পাশাপাশি লেখা আছে— “শহীদ মিনার : ভাষার প্রতি ভালোবাসার মিনার।” তার ঠিক নিচে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে বিবৃত হয়েছে— “এই শহীদ মিনারটি ১২ই জুলাই, ২০০৫ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তোশিমা-কু কে উপহার দেন। এ উপহার তোশিমা-কু ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক অনন্য নিদের্শন, যা এই ইকেবুকুরো নিশিগুচি পার্কে জাপান বাংলাদেশ সোসাইটি উদ্যোগে আয়োজিত বৈশাখী মেলার মাধ্যমে সূচিত। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের সম্মানে নির্মিত এই মিনার, ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (২১ শে ফেব্রুয়ারি) এর প্রতীক স্বরূপ। শহীদ মিনারের মাঝখানের অংশটি ভাষা মা, যাঁকে রক্ষা করতে দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে চার সন্তান।”
কলকাতায় শহীদ মিনার
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ময়দানে এটি অবস্থিত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমান্ডার মেজর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনি এটি নির্মাণ করেন। একসময় এটি অক্টারলোনি মনুমেন্ট নামে পরিচিত ছিল। এর বর্তমান নাম শহীদ মিনার। এর উচ্চতা ৪৮ মিটার (১৫৭ ফুট)। মিশরীয়ান, সাইরিয়ান, তুর্কীয় স্থাপত্যের আদলে এটি তৈরি করা হয়েছে। এর প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন ডেভিড অক্টারলোনি। মূলত গুর্খা আন্দোলনের (১৮১৪-১৬) বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এটি নির্মাণ করা হয়।
পরবর্তীকালে এটি উৎসর্গ করা হয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে। আর এভাবেই এটির নামকরণ হয় শহীদ মিনার। এ শহীদ মিনারটি দেখতে অনেকটা দিল্লীর কুতুব মিনারের মতো। এর শীর্ষদেশে দুটি ব্যালকনি আছে, যা সিঁড়ির মাধ্যমে ওঠা যায়। এর দক্ষিণ পাশে যে বিস্তৃর্ণ মাঠটি অবস্থিত তা ময়দান হিসেবে পরিচিত। এই ময়দান সকল প্রকার রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাক্ষী এই ময়দান। ১৯৩১ সালে এই ময়দানে অনুষ্ঠিত প্রথম রাজনৈতিক সভাটিতে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভারতে রয়েছে ৩টি শহীদ মিনার। এর মধ্যে দুটি হলো পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া এবং চন্দন নগরে। তা ছাড়া ১৯৬১ সালে শিলচরে সেখানকার শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মিত হয়। এমনকি কলকাতার উপ-দূতাবাসের প্রাঙ্গণেও শহীদ মিনার নির্মিত হচ্ছে। প্রায় দেড় লাখ রুপি ব্যয়ে আর সিসি ও টাইলস দিয়ে তৈরি হচ্ছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে। এ স্মারকটির ভিত্তি ৩ ফুট ও উচ্চতায় ১১ ফুট। (সূত্র : বিদেশে শহীদ মিনার, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ
এটি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের ওরমন্ড স্ট্রিটের অ্যাসফিল্ড পার্কে অবস্থিত। ১৯ শে ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। এর উদ্বোধন করেন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত তৎকালীন বাংলাদেশের হাই কমিশনার এইচ. ই. আশরাফ-উদ-দোল্লা। স্মৃতিসৌধটি সম্পূর্ণ পাথরে তৈরি। এর সম্মুখভাগে একটি গ্লোব বসানো আছে। মূলত বিশ্বব্যাপী ভাষা ও সংস্কৃতিকে উৎসাহদানে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পর বহির্বিশ্বে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর সফল বাস্তবায়ন এই স্মৃতিসৌধ।
এটি অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে একাডেমী-র উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে। বাংলা ও বাঙালির গৌরব ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর উৎস দিনে নিবেদিত মহান শহীদের ত্যাগ ও সম্মানকে চির অম্লান করার পাশাপাশি বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর কাছে এ দিনের তাৎপর্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে একুশে একাডেমী, অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফল স্বরূপ অস্ট্রেলিয়ায় নির্মিত হলো এই প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ। অ্যাসফিল্ড কাউন্সিল, সিডনির সহযোগিতায় অ্যাসফিল্ড পার্কে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রস্তাবের পক্ষে অ্যাসফিল্ড কাউন্সিলের নৈতিক অনুমতি প্রাপ্তির মাধ্যমে স্মৃতিসৌধটি বাস্তবায়িত হয়। মূলত একুশে একাডেমি, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসে বাঙালিদের মাঝে একুশে চেতনা লালন ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর তাৎপর্যকে নতুন বাঙালি প্রজন্মসহ সকল ভাষাভাষীর মাঝে তুলে ধরার যে অঙ্গীকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছে, তারই সুন্দর ও সফল বাস্তবায়ন এই স্মৃতিসৌধ।
কানাডায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার চেতনায় নির্মিত স্থাপনা শিল্প
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাকে ধারণ করে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের বিখ্যাত নগরী ভ্যাঙ্কুভারের পাশে ছোট শহর সুরে’র বিয়ার ক্রিক পার্কে নির্মিত হয়েছে স্থাপনা শিল্প লিঙ্গুয়া অ্যাকুয়া (Lingua Aqua)। এটি মূলত ভাস্কর্য, স্থাপত্য, গ্রাফিক, অডিওভিজুয়াল এবং জলতরঙ্গের এক নান্দনিক বিন্যাস। ২০০৯ সালের ১১ জুলাই এই নান্দনিক মনুমেন্টটির উদ্বোধন করা হয়। ‘lingua franca’ শব্দের ভেতরই বীজ লুক্কায়িত আছে Lingua Aqua শব্দটির। ‘lingua franca’ শব্দের অর্থ সর্বজনীন ভাষা। এ প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে : A lingua franca (or working language, bridge language, vehicular language) is a language systematically used to make communication possible between people not sharing a mother tongue, in particular when it is a third language, distinct from both mother tongues. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সঙ্গের এর সম্পর্ক এই যে, দিবসটি যেমন বিশ্বের সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ ভাষাভাষী মানুষদের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার দাবিতে সোচ্চার করে তোলে, তেমনই সকলকে সর্বজনীন ভাষাবোধে একাত্ম হতে আহ্বান করে।
লিঙ্গুয়া অ্যাকুয়া দেখতে ছোট প্যাভিলিয়ন বা ছাউনির মতো। এর দুই প্রান্তে দুটি জলপ্রবাহ। এর একটি মেঝের সমতলে আয়তকার জলাধার আর অন্যটি ছাদ থেকে নিচের জলাধার পর্যন্ত প্রলম্বিত। এর দুটি ঝরণাধারা,যা নিচের জলধার থেকে জল সংগ্রহ করে আবার উৎসে ফিরিয়ে নেয়। অর্থাৎ রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া এটি সম্পাদিত হয়। জলধারটির ঠিক নিচে জল-প্রতিরোধক একটি ভিডিও আছে, যাতে প্রায় ১০০টি দেশের বিভিন্ন ভাষার অনুষ্ঠান রেকর্ড করা আছে। দর্শকরা জলের ভেতর দিয়েই এটিকে দেখতে পায়। ভিডিও প্রোগ্রামগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে,নির্দিষ্ট কোনো ভাষাভাষীর মানুষ যদি এ জলাধারটির সামনে এসে কিছুক্ষণ কথা বলে তাহলে ভিডিওটি সেই ভাষার সংকেত অনুসরণ করে ঐ ভাষার ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে।
এ শিল্প স্থাপনাটি বহু ছিদ্রযুক্ত চারটি ফাঁপা ধাতব স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ স্তম্ভগুলোর ভেতর রাখা আছে অডিও ব্যবস্থা। এ অডিও-র মধ্য দিয়ে ভিডিও-সম্প্রচারের আওয়াজ দর্শক-শ্রোতার কানে এসে পৌঁছায়। স্তম্ভের গায়ের ছিদ্রগুলো মূলত ব্রেইল পদ্ধতি লেখা ভাষা সম্পর্কিত কিছু উদ্ধৃতি। এগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। অনেকের মতে, লিঙ্গুয়া অ্যাকুয়া শুধু বাংলা ভাষারই নয়, পৃথিবীর বিলুপ্ত এবং জীবিত সকল ভাষার এক অন্যতম গৌরবোজ্জ্বল ভাস্বর হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে শহীদ মিনার
প্যারিসে অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে ইউনেস্কো। ২৭ মে ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক চর্চার বৈঠকখানায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে এ আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা। প্রধানমন্ত্রীও এ মহৎ উদ্যোগকে আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানান এবং বলেন, এ কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ইউনেস্কোকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করবে বাংলাদেশ সরকার। এর ফলে বাঙালি ও বাংলাদেশের জনগণের গর্বের প্রতীক শহীদ মিনার বিশ্বের মাঝে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।
এছাড়া দেশের বাইরে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস শহরে নির্মিত হয়েছে স্থায়ী শহীদ মিনার। তবে অস্থায়ী একটি শহীদ মিনার রয়েছে নিউইয়র্ক শহরে। জাতিসংঘ দপ্তরের সামনে এ মিনারটি নির্মাণ করেছে ‘মুক্তধারা’। নিউইয়র্কস্থ সংবাদ সংস্থা এনা এক বিবৃতিতে জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি শহরে অর্ধশতাধিক অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপিত হবে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়, যা প্রতি বছরই ২১ শে ফেব্রুয়ারি গড়া হয় এবং শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ভেঙে ফেলা হয় সেটি।