শাহাবুদ্দিন আহমেদের রংতুলির ‘শান্তি’

জীবনের ভেতর ও বাইরের শৈল্পিক যে রূপ চিত্রকলায় প্রকাশিত হয়, সে রূপ যথার্থভাবে রংতুলির আঁচড়ে ক্যানভাসবন্দি করতে শিল্পীরা আজীবন সাধনা করে যান। এ সাধনা এতই ব্যাপৃত যে গোটা জীবন উৎসর্গ করার পরও অনেক সময় গন্তব্য অধরাই থেকে যায়। শত শত ক্যানভাস রাঙানোর পরও শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি আঁকার জন্য জাতশিল্পীর মনের ভেতর অসংখ্য অতৃপ্তির পাখি খেলা করে। তাই তৃপ্তির মতো অমৃত সুখ ও অমরত্বের সন্ধানে শিল্পীকে শিল্পের কণ্টকাকীর্ণ রাস্তায় পথ চলতে হয় অবিরাম। শাহাবুদ্দিন আহমেদ চিত্রকলার জগতে অবিরাম ছুটে চলা শিল্পীদের একজন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি শিল্পের চর্চায় নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন এবং বাংলাদেশের চিত্রশিল্পকে বৈশ্বিক উষ্ণতা পর্যায়ে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। গত ১৯ মার্চ থেকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে চলছে শাহাবুদ্দিন আহমেদের একক প্রদর্শনী ‘শান্তি’। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রদর্শনীতে সর্বমোট ৩২টি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে।
শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্রকর্মের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ‘গতি’। চলমান সময়কে তিনি ফ্রেমবন্দি করার চেষ্টা করেন। তাঁর চিত্রকর্ম যেন মুহূর্তের উপস্থাপন। গতি ও পেশিবহুল দেহ উপস্থাপনের মাধ্যমে শিল্পী প্রকাশ করেন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অপরিসীম সাহস। শাহাবুদ্দিন বৃহৎ ক্যানভাসে, মোটা ব্রাশে কাজ করতে পছন্দ করেন। তাঁর চিত্রকর্মে মুখমণ্ডলের চেয়ে পেশিশক্তি ও গতির প্রাধান্য বেশি লক্ষণীয়। তাঁর ক্যানভাসের গতিবান মানুষগুলোর গন্তব্যও বহু বর্ণিল ও ক্ষিপ্র। চিত্রসমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘শূন্য স্পেসের মধ্যিখান থেকে অতর্কিতে আগুনের গোলার মতো নির্গত হয় তার ছবির মানুষ। গেরিলারা দীর্ঘলাফ দিয়ে তির্যকভাবে বিপরীত কোণের দিকে ছুটে যায়, কখনো নামে তার আকাশ থেকে ছত্রী সেনার মতো, কখনো বুক চিতিয়ে ধেয়ে যায়। সাহসী মানুষের মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করে ছুটে চলার বয়ান শাহাবুদ্দিনের ছবি।’ ‘প্লাটুন’, `Pathos’ বা ‘উদ্দীপনা’, ‘লা ভিক্টোরি’র মতো উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য অনেক চিত্রকর্ম ‘শান্তি’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে দেখতে পারবেন শিল্পামোদীরা।
শাহাবুদ্দিন আহমেদ একাত্তরের বীরসেনানী। মুক্তির জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন, চেতনাকে তিনি ধারণা করেছেন আপাদমস্তক। এর প্রভাব তাঁর শিল্পকর্মে স্পষ্টতই প্রস্ফুটিত। বারবারই তাঁর চিত্রকর্মে উদ্ভাসিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয়ের উল্লাস, গণহত্যার মতো বিষয়-আশয়। শাহাবুদ্দিন আহমেদ ব্যক্তির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ও বিজয়কে উপস্থাপন করতে চান। অধিকাংশ সময়ই একজন মাত্র ব্যক্তির মাধ্যমে শিল্পী মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপৃত পরিসরে তুলে ধরেছেন। ব্যক্তির মধ্য দিয়ে শিল্পী সমষ্টিগত চেতনায় পৌঁছাতে চান। আলোচ্য প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া এ ঘরানার ছবিগুলোর মধ্যে ‘ফ্রিডম’, ‘লিবার্টি’, ‘ভেনোরেশন’, ‘বিজয়’ উল্লেখযোগ্য। গণহত্যা নিয়ে `Arreter le genocide’ বা ‘গণহত্যা বন্ধ করুন’ চিত্রকর্মটিও বিশেষ দৃষ্টির দাবি রাখে। জাতির জনকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্নেহ করতেন। শাহাবুদ্দিন আহমেদ একবার বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এঁকে তাঁকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেই ছবি দেখে অভিভূত হয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে বলেছিলেন, ‘তাজউদ্দীন, দেখো দেখো, কী এঁকেছে। এই তো সোনার ছেলেরা আমার।’ ‘শান্তি’ প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কয়েকটি চিত্রকর্ম রয়েছে। তবে এসব ছবির মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক চিত্রকর্মটির কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। মুজিব কোট পরা চিন্তামগ্ন বঙ্গবন্ধু ভাঁজ করা দুই হাতের ওপর মাথা রেখে বসে আছেন। তাঁর পেছনে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। আবার মুজিবের পোশাকেও লেগে আছে লাল ও সবুজের মিশ্রণ যেন আরেক প্রাণের পতাকা। শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাঁর চিত্রকর্মে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি সব সময় জয় বাংলাকে আমার হৃদয়ে ধারণ করি। বঙ্গবন্ধুর কারণে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। তারপরও বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়েছে। আমি আমার ছবিতে সেই কথা বারবার বলি। আমি হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে তার ছবি আঁকি। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা, জাতির জনককে হৃদয়ে ধারণ করা খুব কঠিন। আমি গত পঞ্চাশ বছর ধরে এ চেতনা বহন করে চলছি।’
প্রদর্শনীতে ঢুকতেই বাঁ পাশে দর্শকদের চোখে পড়বে বরেণ্য দুজন মানুষের প্রতিকৃতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধী দাঁড়িয়ে আছেন। শাহাবুদ্দিন আহমেদ পরম মমতায় তাঁদের এঁকেছেন। শিল্পীর তুলিতে এ দুজনের প্রতিমূর্তি কোমল হয়ে ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া এ প্রদর্শনীর তিনটি চিত্রকর্মে নারীর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুটির শিরোনাম ‘নায়িকা’, অন্যটির শিরোনাম ফরাসি : Des jumeaux বা ‘যুগল’। নৃত্যের ভঙ্গিতে ‘ফ্রেমবন্দি’ হওয়া ‘যুগল’ ছবিটি ‘শান্তি’ প্রদর্শনীতে নিঃসন্দেহে বৈচিত্র্য এনেছে। ‘শান্তি’ প্রদর্শনীর মাধ্যমে শাহাবুদ্দিন চিত্রকর্মের ভাষ্যে পৃথিবীতে শান্তির আহ্বান করেছেন। এ আহ্বানও শিল্পীর মাহাত্ম্যকে উচ্চকিত করে।
জাতীয় চিত্রশালা ভবনের ২ নম্বর গ্যালারিতে ‘শান্তি’ শীর্ষক প্রদর্শনী চলবে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত। আগ্রহী শিল্পরসিক এ প্রদর্শনী দেখে যে ঋদ্ধ হবেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।