অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার
জীবন নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই: বেলাল চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যের মেধাবী, সৃষ্টিশীল এবং বোহেমিয়ান কবি বেলাল চৌধুরী। জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর ফেনীর শর্শদি গ্রামে। বাবা রফিকউদ্দিন আহমাদ চৌধুরী ও মা মুনীর আখতার খাতুন চৌধুরানী।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। জীবনের প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ব্যাপী তিনি কবিতা, সাংবাদিকতা, গবেষণা, প্রবন্ধ, অনুবাদসহ সাহিত্যের বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘদিন দায়িত্বে ছিলেন ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের পত্রিকা ‘ভারত বিচিত্রা’র সম্পাদকের পদে। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ, সচিত্র সন্ধানী। বেশকিছু কাল তিনি ভারতের কলকাতায় বসবাস করেন। সে সময়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃত বাজার, যুগান্তর, সাপ্তাহিক দেশ, কৃত্তিবাসে লেখালেখি করেন তিনি। এছাড়া কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি কাজ করেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’-এ ।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে : নিষাদ প্রদেশ, বেলাল চৌধুরীর কবিতা, আত্মপ্রতিকৃতি, স্থির জীবন ও নিসর্গ, স্বপ্নবন্দী, যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে, বত্রিশ নম্বর, সেলাই করা ছায়া। প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- কাগজে কলমে, স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল। এ ছাড়া শিশুসাহিত্য,অনূদিত, সম্পাদিত গ্রন্থসহ কবির প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্য হচ্ছে আটাশটি। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৪ সালে একুশের পদক লাভ করেন। এছাড়াও পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৪), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭), নীহাররঞ্জন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), কবিতালাপ পুরস্কার। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে অজাতশক্র এই কবির সঙ্গে কথা বলেন তরুণ কবি অঞ্জন আচার্য।
প্রশ্ন: কেমন আছেন?
বেলাল চৌধুরী : ভালো না।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
বেলাল চৌধুরী : হ্যাঁ, বলো।
প্রশ্ন: কী করতে বেশি ভালো লাগে?
বেলাল চৌধুরী : ঘরে বসে অলস সময় কাটাতে।
প্রশ্ন: নিশ্চয়ই অনেক লেখার ভাবনা আসে।
বেলাল চৌধুরী : না। তেমন কোনো নির্দিষ্ট ভাবনা আসে না।
প্রশ্ন: তাহলে?
বেলাল চৌধুরী : কত যে বিচিত্র ভাবনা মাথায় খেলে, বলে শেষ করা যাবে না।
প্রশ্ন: কীভাবে কাটে সারাদিন?
বেলাল চৌধুরী : টিভি দেখি না, পত্রিকা পড়ি না। মন চাইলে একআধটু পড়ি।
প্রশ্ন: কী পড়েন?
বেলাল চৌধুরী : কবিতা।
প্রশ্ন: আপনার প্রিয় কবি কে?
বেলাল চৌধুরী : অনেকেই। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ...
প্রশ্ন: তারপরেও যদি একজনকে বেছে নিতে বলি...
বেলাল চৌধুরী : অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ।
প্রশ্ন: একসময় তো খুব আড্ডা দিতেন। কার কার কথা খুব মনে পড়ে?
বেলাল চৌধুরী : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার।
প্রশ্ন: এঁদের মধ্যে কে আপনার প্রিয় বন্ধু ছিলেন?
বেলাল চৌধুরী : কমলকুমার মজুমদার।
প্রশ্ন: তাই? এর পেছনে কি কোনো কারণ আছে?
বেলাল চৌধুরী : তার লেখার স্টাইল, পাণ্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করতো।
প্রশ্ন: আর হাংরি মুভমেন্টের সময় কে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে?
বেলাল চৌধুরী : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তুষার রায়।
প্রশ্ন: কবিতার বাকবদল সম্পর্কে কিছু বলুন।
বেলাল চৌধুরী : কবিতার ভাষা কাউকে সামনে রেখে, তাকে অনুকরণ বা অনুসরণ করে বদলায় না। এটা আসে কবির ভেতর থেকে। পরিবর্তিত ভাষাটা কবি তার নিজের ভেতর থেকেই অর্জন করেন। আর সেটা আসে তার পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে।
প্রশ্ন: এ মুহূর্তে কবিতার জন্য কী দরকার?
বেলাল চৌধুরী : কবিতার পরিবর্তন, ভাষার পরিবর্তন।
প্রশ্ন: একজন কবির জন্য কোন পেশাটিকে আপনি ভালো বলে বিবেচনা করেন?
বেলাল চৌধুরী : কবির জন্য কোনো পেশাই ভালো নয়।
প্রশ্ন: তার মানে?
বেলাল চৌধুরী : একজন প্রকৃত কবি সব পেশাতেই কাজ করতে পারেন। তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। কেবল নিজের মতো করে তিনি পেশাটাকে মানিয়ে নেবেন।
প্রশ্ন: জীবনের এ প্রান্তে এসে কীভাবে মূল্যায়ন করেন ফেলে আসা দিনগুলোকে? এই যেমন, কলকাতা গিয়ে শ্মশানে ঘর ভাড়া করে থাকা, মাছ ধরার ট্রলারে চেপে দেশান্তরী হওয়া, দিনের পর দিন আড্ডা নিছক দিয়ে সময় পার করে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেলাল চৌধুরী : জীবনে যা যা করেছি, সবই ঠিক ছিল। জীবন নিয়ে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।
প্রশ্ন: আবার যদি যৌবনে ফিরে যেতে পারতেন, কী করতেন?
বেলাল চৌধুরী : আবারও এই শিল্প-সাহিত্য নিয়েই মেতে থাকতাম।