নিক্রপলিস : সুখকর মৃত্যুর প্রার্থনা
সাতটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পর কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইনের প্রথম উপন্যাস ‘নিক্রপলিস’। লেখকের নিরীক্ষাধর্মী লেখনশৈলীর ফলে এটি ঠিক উপন্যাস কিনা, তা দুর্বোধ্য মনে হবে পাঠকের কাছে। শুরুতেই নামকরণ প্রসঙ্গ। ‘নিক্রপলিস’ শব্দের অর্থ প্রাচীন নগরীর বৃহৎ সমাধিক্ষেত্র। কেন এমন নাম রাখা? সেই অনুসন্ধান করা যাক। উপন্যাসটির শুরু হয় নামহীন-গোত্রহীন পুরুষের মস্তিষ্কে ক্রমাগত দীর্ঘ হতে থাকা কবিতার আবহের মধ্য দিয়ে : ‘কিছুদিন থেকে ওকে লম্বা কবিতায় পেয়েছে। অরফ্যানেজ থেকে কয়েক ছাত্র—এরকম নাম দিয়ে অনেক কটি বাক্য তৈরি করল মাথায়। ...লম্বা লাইনটি বাড়ছে ...এখন মৃত সাঁওতাল শিশু ঘুমায় গাই ডহরে, অথবা এলোমেলো পা ফেলা কালো গাভির সাদা মিষ্টি সুখ, অদৃশ্য পান করে সাঁওতাল শিশুর মৃত আত্মা!’—এমন অসংগত-শৈল্পিক পঙক্তির সমন্বয়ে কবিতাটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। বৃদ্ধি পায় আরো—‘...শরীর হারাচ্ছে বেঁচে থাকার আর্দ্রতা, জরুরি সোহাগ ছেড়ে মৃত্যু এসে ঘুম নেবে শেষ মৃত্যুর!’
কোনো নির্দিষ্ট সূত্র ধরে উপন্যাসটি অগ্রসর হয় না। কোলাজ চিত্রকলার মতো অসংখ্য চিত্র ফুটে ওঠে একক ক্যানভাসে। একটি ফ্রেমে অগণিত শিল্পকর্ম অথবা অনেকগুলো শিল্পকর্ম মিলে একটি অখণ্ড চিত্র। আছে একখণ্ড গৃহত্যাগী কট্নবাড, আতাগাছ, মাকড়সার জাল, জানালা, দোতলার মেয়ে, ‘লাইফ ইজ এলস্ হোয়ার’ বই, জুতার তলে আটকে থাকা গত রাতের জলবৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া বেওয়ারিশ কাগজ, ‘ব্রাজিল’ লেখা টি-শার্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। সেইসঙ্গে আলোচিত হয় পুরুষের স্পার্ম কত বেগে বেরোয় তেমন আনকোরা প্রসঙ্গ। আসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা নিয়েও আলোচনা। এভাবে যেতে যেতে একসময় জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের ভেতর নিয়ে যান লেখক। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এমনভাবে করতে দেখা যায় যেন কারো জীবন্ত সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। এমন ঘটনার বয়ান পড়তে পড়তে পাঠকেরা সন্ধান পায় বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস। সামরিক পালাবদলের ইতিহাসও উঠে আসে সেখানে, যখন লেখক ব্যক্ত করেন জানা অথবা অজানা সব অধ্যায়।
রাজনৈতিক ঘটনার ফাঁকেই এই বইতে পাওয়া যায় নারী-পুরুষ সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ ও পরিসংখ্যানগত নানা বিচিত্র সব তথ্য—‘দেখুন মেয়েটি যদি চড় মারে, তবে সবাই ভাববে ঐ লোকটিই আদতে আসামী। আবার দেখুন উইমেনদের সমস্ত সমস্যা আসে মেনদের থেকে : মেন-ওপোজ; মেন-স্ট্রুয়াল পেইন; মেন-টাল ইলনেস; গাই-নোকলজিস্ট; হিস-টেরেকটোমি ইত্যাদি। আমরা জন্মের মুহূর্তে নগ্ন, ভেজা এবং ক্ষুধার্ত থাকি, তারপর সব বদলাতে শুরু করে। প্রতি তিনশ পুরুষের মধ্যে একজন আক্রান্ত হয় বুলিমিয়ায়, কন্যাদের মধ্যে তা ৪% - ৫%।
আমরা কেউ ঝগড়া করি অথবা বিরক্তি প্রকাশ করি— তুমি ভয়ংকর সেলফিস, ইনকনসিডারেট, তুমি ব্যবহার করছো জাস্ট লাইক চাইল্ড, তুমি তোমার সমস্যাটা বুঝতে চাও কিন্তু আমাদেরটা না কেনো? আর সবসময় তোমার তাড়া এবং দৌঁড়ে বেড়ানো। আহা! অসাধারণ বাজার-তালিকা বানানোর জন্য পুলিৎজার পুরস্কার নেই। পুরুষগুলো কী করে জানো? প্রতি আড়াই মিনিট পরপর পঁচাত্তরটি চ্যানেল বদলে যায়; যেন টেলিভিশনে কোন বস্তুটি নেই তাই খুঁজছে।
৯৬.৩% পুরুষ ফার্ট করার কথা স্বীকার করে, আর ভদ্রমহিলাদের বেলায় তা ২.১%। কারণ কী? পুরুষেরা গ্যাস-প্রডিওসিং খাবার বেশি খেয়ে ফেলে। আমি বলি অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ ছিল হ্যাপিয়েস্ট অ্যান্ড লাকিয়েস্ট কাপল, কারণ তাদের শাশুড়ি ছিল না। ...বালিকাটি মিথ্যে বলে তোমাকে খুশি করার জন্য আর বালকটি মিথ্যে বলে নিজেকে সুন্দর প্রমাণের জন্য। যুবকটি আরও কয়েকটি মিথ্যে বেশি বলে : আমি আজ একদম নেশা করিনি, ঐ মেয়েটির সাথে আমার সম্পর্ক সেক্স-এর নয়, উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস; আর আমার এক্স-এর সাথে সেক্স ছিল বড্ড লাউজি। ...আসলে কী জানো, যুবকেরা কোনোদিন যুবতীদের বুঝতে পারবে না, আবার যুবতীরাও কোনোদিন যুবকদের বুঝতে পারে না। কাজেই নারী-পুরুষের এই একটি বিষয় কোনোদিন বুঝবে না যে, তারা কোনোদিন পরস্পরকে বুঝতে শেখেনি।’
এ উপন্যাসটির বৈশিষ্ট্য আপাত অনুধাবনযোগ্য নয়। মামুন হুসাইন সেই সুযোগও পাঠকদের জন্য রাখেননি। নিটোল প্রেমের গল্প বলতে বলতে লেখক যখন ইউনূসের দাদন ব্যবসা করে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গল্প বলেন বা ‘অতঃপর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের গল্প শোনাই’—তখন মুহূর্তেই ভাবনার অদলবদল ঘটে যায়। গল্পের ভেতরকার টাইম-স্পেস উধাও করে দিয়ে লেখক বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঘটনার অবতারণা করেছেন নানাভাবে। অসংখ্য সত্য-মিথ্যা চরিত্রের সম্মিলন ঘটিয়ে পাঠককে রীতিমতো দিক্ভ্রান্ত পথিকের মতো ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যক্ত করেছেন ইতিহাসের স্তূপে চাপা পড়া কাহিনী।
শোনান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপকের কথা যিনি একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তীব্র অত্যাচারে নিজের পিতৃদত্ত মজিবর রহমান নাম বদল করে ‘দেবদাস’ করেন প্রতিবাদ হিসেবে। এ বিষয়ে লেখকের সরল উক্তি— ‘ইনফ্যাক্ট এটা দেখানো যে সো কল্ড মুসলিম উম্মার দেশে, হি ডিজওনড... অ্যান্ড ডেসপাইট এভরি রিস্ক চেঞ্জড হিজ নেম...।’
উপন্যাসটির সকল ঘটনা উত্তম পুরুষ ‘আমি’র মুখ থেকে শুনতে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ‘আমি’ কোনো একক স্থির ব্যক্তি নয়। ক্রমাগত ঘটনার সাথে পাল্টে যেতে থাকে ‘আমি’র রূপ ও অবস্থান। বিশেষ কিছু চরিত্রের নাম পাওয়া যায় বটে, কিন্তু কেউ মুখ্য চরিত্র নয়। কবীর, আনোয়ার, তাতাই, নানক, সন্দীপন, মোহাইমেন, রাহী, জাকারিয়া, সাইমন প্রমুখ কেউ-ই এ উপন্যাসের নায়ক নয়। ‘আমি’ই এখানে মূল চরিত্র। যে এই ‘আমি’র কর্তৃত্ব করে, সে-ই তখন মূল চরিত্র হয়ে ওঠে। ইতিহাসের এক অস্থির সময়ের কথা বলে যেতে চায় যেন এই ‘আমি’। ব্যক্তি থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রিক পর্যায়ে এ চরম অস্থিরতা প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত করে মানুষকে।
প্রসঙ্গক্রমে আসে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদের আগ্রাসন। ধর্মের ধোঁয়া তুলে চলে ক্রমাগত জঙ্গি হামলা। বইটিতে একটি আলাদা শিরোনাম রাখা হয় ‘ইজ বাংলাদেশ হ্যাভিং আ নেটওয়ার্ক অফ টেরোরিজম?’। সে অধ্যায়ে আসে ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার বিবরণ। রমনা বটমূলে, গির্জায়, সিনেমা হলে, রাজনৈতিক সমাবেশে, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা প্রসঙ্গ, যা নিরীহ মানুষকে শঙ্কিত করে প্রতিদিন। শ্যামল বাংলাদেশ প্রায় রক্তাক্ত দেশে পরিণত হয়। এ বিভীষিকাময় বাস্তবিক বীভৎস চিত্র তুলে ধরেন মামুন হুসাইন তাঁর এ উপন্যাসে।
২০১১ সালেই এ উপন্যাস লাভ করে ‘বাঙলার পাঠশালা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পুরস্কার’। বইটি আগে শুদ্ধস্বর থেকে বেরোলেও এ বছর বেরিয়েছে উড়কি প্রকাশনী থেকে।