রেজাউদ্দিন স্টালিনের পাঁচটি কবিতা
বিচ্ছেদের বর্ণমালা
আমাদের দেখা আর কখনো হবে না কোনোদিন
এমনকি কণ্ঠস্বর টেলিফোনে হবে না মুদ্রিত
স্মৃতির পাখিরা এসে বলে যাবে সুরঞ্জনা শোনো :
কাল সারারাত জেগে বিচ্ছেদের বেদনা লিখেছি
ফিরিয়ে নিয়েছি মুখ পরস্পর ক্ষোভে ও ঘৃণায়,
কে জানতো মুহূর্তের মরীচিকা কেড়ে নেবে আলো
বুকের ভেতর থেকে জেগে ওঠা একখণ্ড ভূমি
দখল করবে এসে নগরের নিকৃষ্ট মাতাল
পৃথিবীর দীর্ঘতম সেতুর উপরে উভয়ের
দেখা হবে, কথা ছিলো নক্ষত্রের বিশাল টাওয়ারে
শিশিরের শিহরণে, স্বপ্নগর্ভ আকাশের নিচে
জোছনার টার্মিনালে অন্তহীন অপেক্ষা করবো
মাইক্রোওয়েভ থেকে আমাদের ধ্বনিপুঞ্জগুলি
শুনবে পৃথিবীবাসী, আমরা থাকবো বহুদূরে
আরণ্যক স্তব্ধতায়, ফরেস্ট বাঙলোর কোনো রুমে
কথা ছিলো বাঙলোর সংলগ্ন সড়কে যদি হর্ন
দেয় মার্সিডিজ বেঞ্জ, আমরা ছুটবো ভিন্নগ্রহে
আমাদের সব ইচ্ছা স্বপ্নসাধ মুহূর্তের ভুলে
ভেঙে গেছে, যার ফলে মর্মন্তুদ বিচ্ছেদের নদী
সৃষ্টি হলো আজ দেখো জীবনের প্রতিপার্শ্বব্যেপে
এখন কী করে বলো সহ্য করি এতোটা নির্মম
আমাদের দেখা আর কখনো হবে না কোনোদিন
এমনকি কবিতারা টেলিফোনে হবে না মুদ্রিত
নীরব নায়িকা এসে বলে যাবে, শোনাও তো দেখি
নিদ্রাহীন লাল চোখে লিখেছো যে, কষ্টের কবিতা
নিরো
বাড়িটার টনক নড়লো, লোকটারও
সাপের স্নিগ্ধতায় লকলক করে উঠলো আগুন
বাড়িসুদ্ধ লোকের মাথায় তখন ভেঙে পড়া আকাশ
কী ভয়ংকর টুকরো টুকরো আগুন, বজ্রের ভগ্নাংশ
বাড়িটার বুকের ভেতর পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিলো
মূল্যবান তৈজস হরিণের শিং সিংহের চর্বির তেল পারদ ওঠা আয়না
একটা জং-ধরা ছুরি কারোবা সঙ্গমের আশ্চর্য দলিল
লোকটা খুব চঞ্চল হয়ে উঠলো
তার শখ ছিলো একদিন কোথাও আগুন লাগলে
সে বাঁশি বাজাবে
কারণ নিরোর কাহিনীটা সে জানতো, শুনেছিলো মাতামহীর কাছে
আগুন লাগলে কেউ বাঁশি বাজায়, মানুষ এমন মর্মান্তিক
আর আজ তারই বাড়িতে আগুন
সে বিহ্বল হয়ে পড়লো
যেন কীটসের গোলাপ দর্শন
লোকটার বার বার মনে পড়তে লাগলো বাঁশি বাজানোর কথা
কিন্তু বাঁশিটা কোথায়
হঠাৎ সে বাঁশিটার খোঁজে আগুনে ঝাঁপ দিলো
এই লোকটাই সারা পৃথিবীতে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে
রোমে, গেটিসবর্গে, ট্রয়ে, জুরিখে, এথেন্সে
হেবরনে, ঢাকায়।
সহমরণ
সহমরণের তৃষ্ণা ও রাত্রি অপরিসীম
সমুদ্রের চিতায় স্বেচ্ছায় উঠেছে আকাশ
ঢেউঅগ্নি ঝলসে দিচ্ছে তার দেহ
আগুন আর অনন্তের এমন অলৌকিক ভূবিজ্ঞানে নেই
কলম্বাসের পরে এই দৃশ্য আর কেউ
দেখেছিলো কি না সেই কথা রহস্যজনিত
ও হাওয়া সৈকতের স্নিগ্ধ চোখে ঘুম
কে তাকে তুলবে সাম্পানে মৎস্যযাত্রায়
লবণের লোভ থেকে মুক্ত হওয়া ভার
ঝিনুক-নুড়ির গান অনেক প্রাচীন
সেই কবে বিগল জাহাজে ডারউইন এসেছিলো
পূর্বপুরুষ অন্ত্যজ শামুকের খোঁজে
আর কেউ এসেছিল নাকি
ভাস্কোদাগামার সাথে রক্ত পুঁজ সিফিলিস
আরো কতো মারি এসে জোয়ার জরিপ করে গেছে
ও চাঁদ রাত্রির একান্ত প্রজাতি
সাগরকন্যার পাণিপ্রার্থী হও
না হলে শুনতে হবে ভ্যাম্পায়ার ভাটার ভর্ৎসনা
নীল ও অলড্রিন ভেঙে দেবে তোমার পৌরুষ
আকাশের সাথে উঠে এসো সমুদ্রচিতায়
আত্মদানের এ সুযোগ অভূতপূর্ব
এর চেয়ে চিরন্তন মৃত্যু আর হতেই পারে না
অন্বেষণ
প্রত্যেকেই ভুলে যেতে চায়,
আমিও চেয়েছি?
মন টানে
পেছনে তাকাই;
চোখের চুম্বন পেয়ে বিক্ষত অতীত
জেগে ওঠে।
শিশির শুকিয়ে যায়,
রৌদ্রের রিরংসায় কাঁপে চলাচল;
পিপাসার পানি যায়
মোহান্তের খোঁজে।
অনিবার্য কে পথ না পিপাসা,
এ প্রশ্নে পুড়ে যায় লক্ষ প্রণোদনা।
পেছনে তাকাই
তন্নতন্ন করি ব্রহ্মাণ্ডের বাড়ি—
পাওয়া যায় দীর্ঘ বিস্মৃতি।
ভালোবাসা ভয়ংকর খুব ক্ষণস্থায়ী,
প্রাপ্তি নেই—না পাওয়ার হিংস্র হাহাকার।
মন টানে
পেছনে তাকাই,
বিশীর্ণ আত্মার নদী দিগন্তে নীরব।
বলতেই হবে
বলতেই হবে
সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা
কীভাবে তার আয়ত চোখের ভেতর
আবিষ্কৃত হলো মৃত্যু
আলো-অন্ধকারের ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায়
তার চুলের ঝিকমিক নক্ষত্রের কথা
বলতেই হবে ঝাউবীথির বিষণ্ন মেদুর ভ্রুর কথা
বক্ষময় বিচরণশীল অশ্বারোহীর উদ্দেশ্যের কথা
যখন তার মুখ অহোরাত্র মর্মরিত তন্ত্রীর তারে
নাম না জেনেও তাকে সর্বস্ব বলে, স্বাতী বলে—সম্বোধন
আকাশে দীপ্যমান গ্রহের নামে তাকে ডাকা
হৃদয়ের ডঙ্কা বাজিয়ে শাঁখ বাজিয়ে
খোল-করতাল বাজিয়ে আহ্বান
সে কি শুনতে পায় না অনন্ত আর্তস্বর
প্রেমে প্রতীক্ষায় এতো বিভোর অক্লান্ত
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মজনুকে এতো বিদীর্ণ হতে কে দেখেছে
ইউসুফকে অপ্রতিরোধ্য হতে
এমনকি ম্যাকবেথকে আত্মসংহারক
অকপটে বলতেই হবে সত্যলব্ধ শ্লোকের কথা
শাহ্নামার চেয়ে দীর্ঘ ব্যঞ্জনাময় মহাকাব্য
বেদনা বিরোচিত পদ্মাবতীর পদের চেয়ে পুণ্যবান
বিদর্ভ আকাঙ্ক্ষার কথা বলতেই হবে
পথে পথে ছড়ানো-ছিটানো ভগ্নাংশের কথা
আর ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী আত্মবিনাশের কথা
জানাতেই হবে প্রার্থনা
মঙ্গলের প্রভু এ জীবন মুক্ত করো মরীচিকা থেকে
সুন্দরের আরাধনা ক্লান্তি থেকে ত্রাণ করো
মানব রচিত বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে
হৃদয়কে বিচ্ছিন্ন করো জাগতিক থেকে
স্বনির্বাচিত করো সংমুদ্ধ সময়ে