ঢাকার কথা ২৫
বিদেশি পেশাজীবী
বিদেশি বণিকদের ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেখা যায় মোগল আমল থেকেই। তবে ঢাকায় ইংরেজ শাসন আমলে বিদেশি বণিকদের আগমন বৃদ্ধি পায়। এসব বণিক তাদের নানা ধরনের বাণিজ্য সম্ভারের পসরা সাজাত। ইরানীরা মোগল আমল থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশে ঢাকায় আসত। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত কোনো কোনো ইরানিকে ঢাকায় ব্যবসা করতে দেখা যায়। কাবুলিওয়ালাদের কথা তো বাংলা সাহিত্যে দেদার আছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষ প্রতীকী চরিত্র হিসেবে কাবুলিওয়ালাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর চীনারা পৃথিবীর নানা দেশের মতো ঢাকায়ও বিশেষ করে জুতার কারখানা খুলে বসে। কাবুলিওয়ালা আর চীনা জুতাওয়ালাদের নিয়ে আজ আলোচনা করব।
আফগানিস্তানের কাবুল থেকে আসা এই বণিকরা কাবুলিওয়ালা নামেই সাধারণ্যে পরিচিত। পরে কাবুল ছাড়াও আফগানিস্তানের যেকোনো স্থান থেকে আসা আফগান ব্যবসায়ীরা কাবুলিওয়ালা বলেই সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়। বিশালদেহী কাবুলিওয়ালারা কাঁধে বড়সড় ঝোলায় নানা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে ফেরি করে বেচাকেনা করত। তাঁদের এই পণ্যের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল আফগানিস্তান থেকে আনা নানা ধরনের শুকনো ফল। ফলকে সাধারণভাবে কাবুলিওয়ালারা ‘মেওয়া’ বলত। এ কারণে এরা ‘মেওয়াওয়ালা’ নামেও পরিচিত ছিল। ফলের পাশাপাশি কাবুলিওয়ালারা নানা ধরনের মূল্যবান মসলাও বিক্রি করত। তাদের সঙ্গে রাখা দ্রব্যের তালিকায় ছিল আখরোট, কিশমিশ, পেস্তা-বাদাম, গরম মশলা ইত্যাদি।
কাবুলি ওয়ালাদের একেকটি দল আফগানিস্তান থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। অর্থাৎ দলবেধে তারা ব্যবসা করতে আসত। ইংরেজ শাসন আমলে এমন এক একটি দল ঢাকা নগরিতে এসে নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলে বাসা ভাড়া করে থাকত। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকে কাবুলিওয়ালাদের একটি দল বসবাস করত ঢাকার বংশাল এলাকায়। ফল ও মসলা বিক্রির পাশাপাশি কাবুলিওয়ালারা সুদে টাকা ধার দিত। এ সময় রাষ্ট্রীয় আইনে সুদে টাকা ধার দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তাই কাবুলিওয়ালারা গোপনে এই ব্যবসা চালাত। ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে রাতে এসে চুপিসারে সুদের টাকা নিয়ে যেত।
পরিজন ছেড়ে প্রবাসে থাকা এই নিঃসঙ্গ কাবুলিওয়ালারা সুযোগ পেলে তাদের দেশীয় সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করত। এর একটি চমৎকার উদাহরণ দেওয়া যায় ঈদের সময়। ঈদের দিন কাবুলিওয়ালাদের নাচ দেখতে নগরবাসী অনেকে জড়ো হতো পল্টন ময়দানে। কাবুলিওয়ালা ঢোলের তালে তালে রঙ্গিন রুমাল উড়িয়ে নাচত।
গত শতকের ষাটের দশকের পর ধীরে ধীরে কাবুলিওয়ালারা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। একেবারে ফিরে যায় নিজ দেশে।
চীনারা অস্থিমজ্জায় বণিক জাতি। আজ যেমন বিশ্বজুড়ে নিজপণ্যের বাণিজ্য ছড়িয়ে দিয়েছে চীন, অতীতেও তেমনটি ছিল। তাই পৃথিবীর নানা দেশে চীনাদের বাজার গড়ে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই ‘চীনা মার্কেট’ নামটি দেখা যায়। ইংরেজ শাসনামলে ব্যবসা করতে চীনারা ঢাকায় আসে। পুরোনো ঢাকার ইমামগঞ্জের প্রবেশ মুখে এমনই একটি চীনা বাজার ছিল। সাধারণের কাছে তা পরিচিত ছিল ‘চীনাপট্টি’ নামে। চীনাদের আট দশটি জুতার দোকান ছিল এখানে।
চীনাপট্টি ঘিরেই ছিল জুতার কারখানা ও বসতিস্থল। অনেক চীনা ব্যবসায়ী পরিবার-পরিজন নিয়েই বসবাস করত। ছেলেমেয়ে স্ত্রীসহ সবাই কারখানা ও দোকানে কাজ করত। ব্যবসার খাতিরেই তারা কিছুটা বাংলা শিখে নিয়েছিল। তাদের মুখে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা শুনে ক্রেতারা মজা পেত। ঢাকা শহরের বিলাসী মানুষদের কাছে চীনা জুতার বেশ কদর ছিল।
পুরো ইংরেজ শাসনেই চীনারা জুতার ব্যবসা করেছে ঢাকায়। পাকিস্তান আমলের শুরুতে ধীরে ধীরে এরা ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকা থেকে চলে যেতে থাকে। এরপর কয়েক ঘর চীনা ঢাকায় বসতি টিকিয়ে রাখে। এরা লন্ড্রি ব্যবসা শুরু করে। এখনো ঢাকায় চীনাদের কয়েকটি ড্রাইক্লিনার্স লন্ড্রি দেখা যায়।