সোমনাথ হোর
শিল্পে রাজনৈতিক দর্শনের ছাপ
বাংলায় আধুনিক শিল্পচর্চাকারী শিল্পীদের মধ্যে সোমনাথ হোর অন্যতম ব্যক্তিত্ব। কেন অন্যতম? ভাষাশাস্ত্র মানলে এই ‘অন্যতম’ অনেকের মধ্যে এক। কিন্তু এই এক, একা নয়। কেন একা নয়? সেই তর্ক শিল্পে আধুনিকতার প্রশ্নে। বাংলায় আধুনিক শিল্পীদের নিজের আত্মসমালোচনা করতে খুব কম দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে শিল্পী সোমনাথ হোরের নিজের একখানা জায়গা আছে। নিজের শিল্প সম্পর্কে ছিলেন সংশয় আকীর্ণ। সাংবাদিক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শিল্প সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। শেষ জীবনে তাঁর সংশয়, আমি ‘মধ্যবিত্তের রোমান্টিকতা’ আক্রান্ত বা অতিক্রম করতে পেরেছি! কেন তাঁর মনে এই সংশয়? রাজনৈতিক ভিত ছাড়া এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হবে না।
আঠারো শতকে পশ্চিমা দুনিয়ায় রোমান্টিকতার বিকাশ শিল্প বিপ্লবের ভেতর দিয়ে। এটা খানিকটা শ্রেণিগত সংঘাতের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। শিল্পের অভিজাত সমাজ আর রাজতন্ত্রকে নাকচ করার ভেতর দিয়ে ভিতটা তৈরি হয়। মানব মনাবেগের এই স্বতঃস্ফূর্ত ধরন সহজ ইতিহাস (natural history) নির্মাণ করেছিল। কিন্তু সোমনাথ হোরের যে ‘মধ্যবিত্তের রোমান্টিকতা’, সেটা আসলে রাজনৈতিক কাঙ্ক্ষার এক অপারগতার প্রকাশ। গোটা জীবনাদর্শ তিনি যে সমাজ দেখতে চেয়েছেন, তার বাস্তবায়ন না হওয়ার এক সমালোচনা। প্রশ্নটার আরো সামনে আগালে দেখা যাবে, নিছক একক ব্যক্তির রাজনৈতিক কাঙ্ক্ষার বাইরে শিল্পকে তিনি সাধারণ মানুষের মনাবেগ কিংবা সংগ্রামের মওকা হিসেবে দেখেছেন। কেন? প্রথমত, তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা; দ্বিতীয়ত, আদর্শিক অবস্থান; তৃতীয়ত, তাঁর শ্রেণিগত অবস্থান। কেননা, রাজনৈতিকভাবে তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের অধিকারী ছিলেন। এই সচেতনতা তাঁকে ব্যক্তির এককত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে বাধ্য করেছে। কেন?
সহজ ভাষায়, আধুনিক শিল্পের নন্দনতত্ত্ব খাড়া হয়েছে দুইভাবে। পয়লা ভাব ‘শিল্পের জন্য শিল্প’। অন্য ভাব ‘মানুষের জন্য শিল্প’। প্রথম ভাবের শিল্প মানুষপ্রধান নহে, শিল্পই তার নন্দনের ভিত। প্রধানত এটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির অভিব্যক্তির প্রকাশ। মানে ব্যক্তিক মনের নন্দনতাত্ত্বিক প্রকাশের ধরন। এই ধরন অরাজনৈতিক। এই ধরনে ব্যক্তি থেকে শিল্পকে আলাদা করে দেখার রেওয়াজ আছে। এই রেওয়াজের বড় ফাঁক খোদ ব্যক্তির অভিব্যক্তিকে বড় করে দেখা। দর্শনশাস্ত্রের কথা মানলে বলা যায়, ব্যক্তি নিছক ব্যক্তি নহে। এর ভেতরে বাস করে অপর। মানে আপনের অন্য পর। ফলে যে নৈর্ব্যক্তিক ধারণা হতে এটা শিল্প হিসেবে চিহ্নিত, সেটা খণ্ডিত। কেননা, শিল্প মাত্র ব্যক্তি নিরপেক্ষ নহে। শিল্পের ভাবগত জায়গায় ব্যক্তি নিরপেক্ষ অবস্থান অমূলক।
অপর ধরনটি রাজনৈতিক। মানুষ তার কেন্দ্রে, নিছক ব্যক্তির অভিব্যক্তি এখানে গৌণ। দর্শনের ভাষায় আরো একটু এগিয়ে বলা যায়, মানুষের দর্শন। কেমন সেই দর্শন? শিল্পকে এই দর্শন মানুষের কালেক্টিভ কনসাসনেসে রূপ দেয়। রাজনৈতিক, আদর্শিক আর নৈতিক রূপের দোহাই এই শিল্পের মূল ভিত। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ভারতীয় শিল্পী সোমনাথ হোর অপর ভাবের শিল্পী। অপর মানে পর নয়। পরকে অ-পর করা শিল্পী। কেমন তাঁর শিল্পকর্ম?
শিল্পী সোমনাথ হোরের শিল্পের বড় উৎস আধুনিকতার ‘অবক্ষয়’ বা ‘ক্ষত’। কেন ক্ষত? ভাষাগত দিক থেকে এটি এমন এক চিহ্ন, যা বাস্তব অবস্থার অপর রূপ। এই রূপ প্রকৃতির রূপ নয়। বাস্তবে প্রকৃতি এই ক্ষত সৃষ্টি করে না। এই ক্ষত বাস্তবের সংঘাতময় রূপ। কেমন সংঘাত? এই সংঘাতের সৃষ্টি সামাজিক চেতনা হতে। সামাজিক চেতনা বলছি এই কারণে, তাঁর শিল্প তিনটি দিক বেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। প্রথমত, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ; দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক মতাদর্শ; তৃতীয়ত, শিল্পের নন্দতাত্ত্বিক কুঠুরি। আর এই তিনটি দিকের কেন্দ্রেই মানুষ। তবে সোমনাথ হোরের মানুষ পূর্ণ মানুষ নহে। এই মানুষ বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত আর জ্বরা আক্রান্ত। কেন?
ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় রাখলে তাঁর আত্মপরিচয় খানিকটা চোখের সামনে মালুম হয়। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যেমন বলেন, একজন মানুষের আত্মপরিচয় এক নহে, বহুমাত্রিক। এই বহুমাত্রিকতায় তিনি ভূখণ্ড, জাতীয়তা, ধর্ম, বর্ণ, ভাষাসহ নানা কুঠুরির তলানির তলা দিয়ে মানুষের নানা পরিচয় দেখিয়েছেন। তাঁর এই বহুমাত্রিক ধারণা মূলত সাম্রাজ্যবাদের যুগে বহুজাতিক বাহিনীর মতো। যে পরিচয় বহুরূপী। আধিপত্যবাদের যুগে কখনো গণতন্ত্র, কখনো মানবতা, কখনো ধর্ম, কখনো বর্ণ, কখনো জাতীয়তার নামে এই পরিচয় নানারূপ ধারণ করে। তাঁর এই পরিচয়তত্ত্বের তলানির তলা শেষ নাগাদ ঠেকে মাল্টি-করপোরেশনে। কিন্তু সোমনাথ হোরের আত্মপরিচয় সেই তলানিতে নেই। পরিচয় কোথায়? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুগে সোমনাথ হোরের জন্ম । ১৯২১ সালে, চট্টগ্রামেই। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা পটিয়ার বরমা গ্রামে। আর প্রাথমিক বিদ্যাশিক্ষা সেখানেই। আইএ পাস করেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে, ১৯৪০ সালে। সে বছরই তিনি কলকাতার রিপন কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। আনুষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষার বাইরে বাল্যকালে তাঁর চারুবিদ্যার হাতেখড়ি। মেদেনীপুরের শিল্পী চিত্তপ্রসাদ রায় চারুকলার খুঁটিনাটি তাঁকে বুঝিয়ে দেন।
সোমনাথ হোরের ছবিতে ঐতিহাসিক দুটি কারণ রয়েছে। দুটি কারণের একটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যটি দুর্ভিক্ষ। ১৯৪২ সালে কলকাতা পরাশক্তি দিয়ে আক্রান্ত হলে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। আনুষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা ছেড়ে দেন। ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। ত্রাণের কাজ করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। থাকতেন পার্টির কমিউনে। প্রচুর ছবি এঁকেছেন তিনি। প্রদর্শনীও করেছেন। তখন তাঁর ড্রয়িং, পোস্টার, নানা শিল্পকর্ম কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা জনযুদ্ধ ও পিপলস ওয়ারে (মুম্বাই) ছাপা হয়। ১৯৪৪ সালে কমরেড ভবানী সেন তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যান। সেখানে কাজ করতে বলেন। ১৯৪৫ সালে সর্বভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নামজাদা নেতা পিসি যোশির আগ্রহে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট কলেজে। সেখানেও চার বছর ছিলেন পার্টির কমিউনে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ ও বঙ্কিম মুখার্জির সান্নিধ্যে। সোমনাথ হোরের বেড়ে ওঠা উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের ভেতর দিয়েই। সেই অর্থে তিনি ঐতিহাসিকতার এক বড় স্বাক্ষর। কেননা, সময় মানুষকে ইতিহাস বানায় না। মানুষের লড়াই-সংগ্রাম সময়কে ইতিহাস আকারে হাজির করে। সময়ের অসারতাকে সারভাবে ফলানো ইতিহাসের কাজ। আর মানুষ নিজেও হয়ে ওঠে ইতিহাস। ফলে ঐতিহাসিক স্বদেশীকতা তাঁর ছবির মর্মমূলে গেঁথে আছে। আর উপনিবেশবিরোধী স্বদেশীকতাই সোমনাথ হোরের আত্মপরিচয়।
সোমনাথ হোর রাজনৈতিক মতাদর্শতাড়িত শিল্পী। কী সেই মতাদর্শ? মার্ক্সীয় দর্শনের তাড়না এই শিল্পীর মনের মুকুরে আষ্টেপৃষ্ঠে বাসা বেঁধে আছে। শ্রেণি বিভাজিত সমাজে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট। আদতে তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে। একে মধ্যবিত্তের আপাত রোমান্টিকতা হিসেবে ঠাওর করা যায়। নিজের শিল্পকর্ম সম্পর্কে সেই আত্মসমালোচনা করেছেন এক সাক্ষাৎকারে। তবে ভুখানাঙ্গা আর পীড়িত মানুষের মুখ তাঁর ক্যানভাসে চাউর হয়ে আছে। ফর্মের দিক থেকে এটা দেখতে অনেকটা জার্মান অভিব্যক্তিবাদী বা জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের মতোই। বিংশ শতাব্দীতে অভিব্যক্তিবাদের প্রথম প্রকাশ বিশ্বযুদ্ধকেই কেন্দ্র করেই। আধুনিক শিল্পকলায় এটি আভাগার্দ হিসেবে চিহ্নিত। অভিব্যক্তিবাদ তিন ভাবকে আমলে নেয়। দর্শনশাস্ত্র বলছে, অভিব্যক্তিবাদ পয়লা বিষয়ীর সঙ্গে জগতের সম্পর্ক নির্ধারণ। দোসরা, মনমরা মানসবৃন্তের পরে নতুন ধারণার উপস্থাপন। তেসরা, আবেগের চেয়ে দৈহিক বাস্তবতাকে হাজির করা। সোমনাথ হোরকে সেই অর্থে আধুনিক অভিব্যক্তিবাদী শিল্পী বলা যায়। নিছক আবেগ নয়, আবেগের সঙ্গে এমন বাস্তব বিষয় বা ঘটনাবলি উপস্থাপনের কাঙ্ক্ষায় স্থির হয় শ্রেণি-চেতনায়। এই শ্রেণি-চেতনায় দেহের সঙ্গে শিল্পের ভাষার এক রফাদফা চলে। সেটা কেমন?
আধুনিক ভাষাশাস্ত্র বলে, ভাষা বা ভাব হচ্ছে দেহের বাড়ি। কেননা, ভাষার আকার দেহের সমান। ভাষা দেহকে আকার দেয়। আর দেহ ভাব লয়ে ভাষা সাকার রূপ লাভ করে। ভাষা দেহের অধরাকে ধরে। দেহও প্রকাশ পায় ভাষার চিত্রণে। ভাষার এহেন অপার রাজনীতিতে দেহও লাভ করে রাজনৈতিক ভাষা। সেই অর্থে ভাষার দেহবাদে সোমনাথ হোরকে চিহ্নিত করা যায়। কেননা, হোর অঙ্কিত দেহ ন্যুব্জ বা ভঙ্গুর আকৃতির। রেখা দোদুল্যমান। এই চিহ্নায়ণের ভেতর দিয়ে তিনি সমাজের রাজনৈতিক ‘ক্ষত’ দেখাতে চান। এটা মূর্ত বাস্তবতার প্রতীক। এই বাস্তবতা অলীক নয়, শোষিত সমাজের মোক্ষম চিত্র। শ্রেণিবিভক্ত বুর্জোয়া সমাজের রাজনৈতিক ফল এতে প্রকাশিত। এহেন রাজনৈতিক বিলয়ে হোরের ছবিতে শান্তি নেই। আছে এক প্রশ্নমুখর রাজনৈতিক বাস্তবতা। অভিব্যক্তিবাদীদের থেকে এবেলায় তিনি খানিকটা আলাদা। সেটা কেমন? ফর্ম অভিব্যক্তিবাদীদের মনে হলেও সোমনাথ হোর আঁকা মুখাবয়ব ঠিক পশ্চিমা মানুষের মুখ নয়। চিত্রে এদের দৈহিক আকার এ অঞ্চলের নিষ্পেষিত মানুষ। অথবা সংগ্রামী মানুষের অবয়ব। এখানেই সোমনাথ হোরের শিল্পের বিশিষ্টতা।
নন্দনতত্ত্বের দিক থেকে এই শিল্পী বিমূর্তবাদী নহেন। বাস্তবেরই মূর্ত ছায়া। ক্যানভাসের আলোছায়ার চেহারায় মুখ কিংবা দেহাবয়বগুলো দেখতে বিষাদময়। তবে তাঁর ক্যানভাসের মানুষ কখনো একাকী, কখনো দলভুক্ত, কখনো সংঘাতময়, কখনো সামাজিক। আধুনিক সমাজের অবক্ষয়ী দৃশ্যের এই বিষাদময়তাকে শুধু ‘ক্ষত’ নামায়নের মাধ্যমে চেনাও খানিক অদূরের। কেন ‘ক্ষত’ নামায়নে সোমনাথ হোরের শিল্পকর্মকে চিহ্নিত করা হলো? কেননা, ‘ক্ষত’ আধুনিকতার এক নিয়ামক মাত্র। আধুনিকতার অপর নিয়ামকগুলোও শিল্পী সোমনাথ হোরের শিল্পে উপস্থিত। ‘ক্ষত’ নামের ভেতর যা উপস্থিত তা হলো ক্ষরণ। কেননা, ‘হোয়াইটস অন হোয়াইট’ সিরিজের ছবিগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শিল্পী নিজেও এসব শিল্পকর্মের নাম রেখেছেন ‘শিরোনামহীন’। ব্যক্তির অভিব্যক্তির অধরাকে ধরা অথবা ধরার অধরা হাজির রাখার নামান্তরই শিরোনামহীন। কেননা, ক্যানভাসের দৃশ্যপটই ছবির নামায়নের জন্য যথেষ্ট।