আজ চার্লির ১২৬
নাপিতের সেই বয়ান

১৯৪০ সাল। বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল বাজছে। মহান চলচ্চিত্রশিল্পী চার্লি চ্যাপলিন এ সময়েই করেছিলেন অসামান্য যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। ছবির শেষাংশে তাঁর, তথা ডিক্টেটর অ্যাডেনয়েড হাইনকেলরুপী নিরীহ ইহুদী নাপিতের দেওয়া ভাষণটি চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংলাপ। চার্লি চ্যাপলিনের জন্মদিনে (১৬ এপ্রিল) শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই ভাষণটি ভাষান্তর করা হয়েছে।
দুঃখিত, কিন্তু আমি কোনো সম্রাট হতে চাই না। এ আমার কাজ নয়। আমি কাউকে শাসন করতে চাইনে, কাউকে দখল করাও আমার অভিপ্রায় নয়। আমি সবাইকে সাহায্য করতে চাই- ইহুদি, অ-ইহুদি, কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ সবাইকে। আমরা সবাই একে অন্যকে সহায়তা করতে চাই। মানুষ তো এমনই। একে অন্যের সুখের মাঝেই আমরা বেঁচে থাকতে চাই- দুঃখের মাঝ দিয়ে নয়। কখনোই একে অন্যকে ঘৃণা বা আঘাত করতে চাই না আমরা। এ জগতে সবারই ঠাঁই পাওয়ার অধিকার রয়েছে। পৃথিবী সমৃদ্ধ আর এই সম্পদ সে সবাইকেই দিতে সক্ষম। জীবনের পথচলা বড় সুন্দর আর মুক্ত। আফসোস, আমরা সেই পথটাই হারিয়ে ফেলেছি।
লোভ আমাদের আত্মাকে কলুষিত করে তুলেছে, পৃথিবীকে রুদ্ধ করে ফেলেছে ঘৃণার দেয়ালে, ধীরে ধীরে আমাদের নিয়ে গেছে দুর্দশা আর রক্তপাতের মাঝে। আমরা করায়ত্ত করেছি গতি, অথচ নিজেরাই কুঁকড়ে গেছি গতিহীনতায়। যন্ত্রপাতির কাজ প্রাচুর্য সৃষ্টি, অথচ তা আমাদের দিয়েছে অসীম চাহিদা। আমাদের জ্ঞান আমাদের পরিণত করেছে নৈরাশ্যবাদীতে। আমাদের চাতুর্য কেবলই রুঢ় আর নিষ্ঠুর। আমরা ভাবি বড্ড বেশি অথচ অনুভব করি সামান্য। যন্ত্রপাতির চেয়েও আমাদের যা বেশি দরকার তা হলো মনুষ্যত্ব। চাতুর্যের চেয়েও আমাদের জরুরিভাবে দরকার সৌম্যতা আর ঔদার্য। এই গুণাগুণগুলো ছাড়া, জীবন হয়ে উঠবে সংঘাতময় আর সবকিছুই হারিয়ে যাবে....
উড়োজাহাজ আর রেডিও আমাদের এনে দিয়েছে কাছাকাছি। এই মহতী আবিষ্কারগুলো মানুষের সভ্য আচরণের জন্য কাঁদে, কাঁদে বৈশ্বিক ভাতৃত্বের জন্য, কাঁদে আমাদের সবার একতার জন্য। এমনকি এ মুহূর্তেও আমার কণ্ঠস্বর পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের কাছে- অগণিত আশাহত পুরুষ, নারী আর ছোট্ট শিশুর কাছে- একটি নিকৃষ্ট সমাজব্যবস্থার শিকার মানুষজনের কাছে, সেসব পুরুষদের যারা নিষ্পাপ মানুষদের নির্যাতন আর বন্দি করতে বাধ্য হচ্ছে এই ব্যবস্থার শিকার হয়ে।
যারা আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন তাঁদের বলছি- হতাশ হবেন না। আমাদের দুর্দশার কারণ হলো লোভ, আর সেসব মানুষদের তিক্ততা যারা মান সমাজের অগ্রগতিকে ভয় পায়। মানুষের এই ঘৃণা আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এটা একসময় ফুরোবে, স্বৈরাচারীরাও মরবে। তখনই, মানুষের কাছ থেকে যে ক্ষমতা তারা কেড়ে নিয়েছিল তা আবার মানুষের কাছেই ফিরে আসবে। সময়ের সাথে সাথে মানুষেরও মৃত্যু হবে, কিন্তু এই স্বাধীনতা কখনো বিনষ্ট হবে না.....
সৈন্যগণ! তোমরা কখনো দানবের কাছে নিজেদের ধরা দিও না- যারা তোমাকে ঘৃণিত করে- যারা তোমাকে বন্দি করে- যারা তোমার জীবন নিয়ে কাটাকুটির হিসাব করে- তুমি কি করবে, ভাববে বা অনুভব করবে- তাও নির্দেশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যারা তোমাকে যন্ত্রের মতো নাড়াচাড়া করে-তোমাকে না খাইয়ে রাখে- তোমায় গবাদিপশুর মতো হেলাফেলা করে- গুলির মুখে ছুড়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে। প্রকৃতিবিরুদ্ধ এই মানুষগুলোর কাছে নিজেদের বিসর্জন দিও না। এরা যন্ত্রমানব, এদের মানসিকতা আর হৃদয়ও যান্ত্রিক। কিন্তু তোমরা তো যন্ত্র নও! তোমরা গবাদিপশুও নও! তোমরা পুরুষ! মানবিক ভালোবাসা জমে আছে তোমাদের হৃদয়ে! তোমরা তো ঘৃণা কর না! ভালোবাসাহীনরাই ঘৃণা করতে পারে- আর পারে যারা কৃত্রিম তারা! সৈন্যগণ! দাসত্বের জন্য যুদ্ধ কর না। লড়াই কর স্বাধীনতার জন্য!
সাধু লুকের সপ্তদশ অধ্যায়ে লেখা আছে- ‘মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের রাজত্ব’- এ তো কেবল একজন মানুষ বা একদল মানুষের মাঝে নয়, সব মানুষের মাঝে! তোমাদের মাঝে! তোমাদের রয়েছে সেই ক্ষমতা- যে ক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে যন্ত্র। সুখ সৃষ্টির ক্ষমতা! এ জীবনকে সুন্দর করে তোলার ক্ষমতা তোমাদেরই রয়েছে। তোমরাই পারবে জীবনের এই পথচলাকে রোমাঞ্চকর আর মুক্ত করে তুলতে।
তারপর- গণতন্ত্রের নামে- এসো আমরা সেই ক্ষমতার সদ্ব্যাবহার করি- সবাই এক হই। এসো আমরা এক নতুন পৃথিবীর জন্য লড়াই করি- যে পৃথিবী হবে শান্ত, যে পৃথিবী মানুষকে কাজ করার সুযোগ দেবে- যে পৃথিবীকে যৌবনকে দেবে ভব্যিষৎ আর বার্ধক্যকে দেবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। অমানুষরা এসবের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু তারা তো মিথ্যে বলেছে! তারা রক্ষা করেনি এসব প্রতিশ্রুতি। কোনোদিন করবেও না!
স্বৈরাচারীরা মুক্ত রাখে নিজেদের অথচ বন্দি করে মানুষদের! কাজেই এসব প্রতিশ্রুতি পূরণে এখন আমাদেরই লড়াই করতে হবে! চলো আমরা পৃথিবীকে মুক্ত করার লড়াইয়ে নামি- জাতীয়তার সীমানা পেরিয়ে কাজ করি- লোভ, ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতাকে এড়িয়ে কাজ করি। চল, একটি যৌক্তিক পৃথিবীর জন্য লড়াই করি, এমন এক পৃথিবী যেখানে বিজ্ঞান আর উন্নয়ন সব মানুষকে এনে দেবে সুখের আস্বাদন। সৈন্যরা! চল, আমরা এক হই, গণতন্ত্রের নামে!