সব্যসাচীর প্রয়াণ
কবিতা পাঠের পর
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম পরিচিতি তো কবিতারই মাধ্যমে, নয় কি? সেই একষট্টি সালের কথা। সে আমার জন্মের আগের কথা। তবু আমি, আমরা বাংলার ষাটের দশককে কত আপন করেই না চিনি। না, সৈয়দ শামসুল হককে এখন শুধু কবি বলেই সম্বোধন করছি বটে, যদিও তাঁর প্রথম কাব্যটি প্রকাশের আগে বেরিয়ে গেছে একটি উপন্যাস, দুটি ছোটগল্পের বই। এবং সেই একষট্টি সালে প্রথম কবিতার বইটি বেরুনোর কয়েক বছরের মধ্যে তিনি পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেই শুরু। তারপর কত পুরস্কার, সম্মান, সম্মাননা না পেয়েছিলেন। তিরস্কারও কি নয়? থাক সে কথা। আজ প্রয়াত কবির কবিতা নিয়ে হোক আলাপ। ভালোবাসার কবিতা। কবিকে ভালোবাসা।
আমার সামান্য পঠনে মনে করে উঠতে পারি কবির তিনটে প্রেমকাব্যের কথা : পরানের গহীন ভিতর, এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি, কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে। আমার সংগ্রহে রয়েছে। হাতের কাছে খুঁজে পাব না। ছিয়াশি সালের পর থেকে কবি শামসুর রাহমানের কোনো কবিতার বই আর আমাকে কিনতে হয়নি। সব তিনি উপহার দিয়েছেন, প্রকাশের স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই। সে সব কি আর খুঁজে পাব? বাসাবদলের নিয়তি যার এই নিষ্ঠুর নগরে, তার বড় কর্তিত জীবন। তবু ভাগ্যকে বাহবা দিই, পেলাম ‘ভালোবাসার দিনে’। কবিকে ভালোবাসার জন্য এই বা মন্দ কি এই ভালোবাসার দিনে। অভিন্ন শিরোনামে ৭১টি স্বতন্ত্র কবিতা। তবে মূল সুর ওই অভিন্নই। কবি এটি লিখেছেন লন্ডনে বসে, ২০০৯ সালের জুলাইয়ের মধ্যভাগে মাত্র দুই সপ্তাহের ভেতরে। এই হলো কবিতার ঘোর, এই হলো ভালোবাসার ঘোর। কবিতার জন্য ভালোবাসা, মানবীর জন্য প্রেম।
প্রেম নিজেই সে গরিব গ্রহের এক আশ্চর্য সুন্দর ধ্বনিময় কবিতা। দুটি টলটলে থরথর উথালপাথাল হৃদয়ের নৈঃশব্দে নিহিত এক পরম প্রাণভোমরা। (আবার একটি হৃদয় নিষ্ক্রিয় ও মৌন রইলেও তুমুল সংঘটিত হতে পারে প্রেম!) প্রেমে পড়লে চতুর চণ্ডালও কবি। আর কবির প্রেম? সে তো মহার্ঘ্যবিশেষ, যার সুঘ্রাণ পায় প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ। প্রতিটি প্রেমই নতুন, বলতে পারি অভিনব। কিন্তু তার অভ্যন্তরে ফুটতে থাকা অনুভূতিগুচ্ছ সকলই পুরাতন। সেই চিরপুরাতনকে নতুন শব্দ ও বাকভঙ্গিমায় চিরনতুন রূপেই কবি আমাদের সামনে তুলে আনতে সক্ষম। তাই প্রেমিক কবিমাত্রই পরম ঈশ্বর!
প্রেমিক কখনো বালকও বটে (কিংবা বালিকা); প্রেমে পাগল হলে সেটাই সংগত। তবু পরিণত কবির প্রেমপঙক্তি চিত্রপটে ধরে রাখে প্রেমের দর্শন, সূক্ষ্ম সঞ্জীবনী। সেখানে প্রাজ্ঞের অভিজ্ঞতার শাঁস, আর প্রতারিতের পতনের ফাঁস মিলেমিশে থাকতে পারে। এখন আমি সৈয়দ শামসুল হকের ‘ভালোবাসার দিনে’ পর্যটন করতে গিয়ে ছুঁয়ে যেতে পারছি ভালোবাসার ভুলগুলোকে, ফুলগুলোকে। কবি নির্দিষ্টভাবে নিজের কথা বলতেন প্রেমের কবিতায়, আবার পৃথিবীর বহু প্রেমিকের বহুল স্বরও বেজে উঠতে পারে তাঁর শব্দে। নিজেকে শত প্রেমিকের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেওয়া, এবং শত প্রেমিককে নিজের মধ্যে ধারণ উভয়ই অসম্ভব নয়। অন্তত কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এমনটা অস্বাভাবিক মনে হয় না। বলতে চাইছি, প্রতিটি প্রেমের কবিতার নায়ক অবধারিতভাবে স্বয়ং কবিই হবেন এটা স্বতঃসিদ্ধ নয়। তবু কবি যখন উচ্চারণ করেন, তা তাঁর নিজেরই জীবনের উচ্চারণ। অপরের প্রেমের অভিজ্ঞতা কবির নিজের ভালোবাসার উপলব্ধি না হলে তা কবিতা হবে কেন? একটি প্রেমকাব্য যদি প্রেমিকমাত্রেরই প্রেমকাব্য হয়ে উঠতে পারে (শতভাগ না হলেও) তবে সেটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের। কবির চরণকে আউড়ে বলা যায়, এ তো আমারই অভিজ্ঞতা, কবি! আমি লিখিনি, আপনি লিখেছেন।
‘তোমাদের মুখের ছবিতে অবিরাম এক নারীকেই তো আমি দেখেছি
পৃথিবীর প্রতিটি প্রেমিকের মুখের ভেতরে আমি দেখেছি আমারই মুখ।’
এ দুটো পঙক্তি বইয়ের উৎসর্গপত্র থেকে নেওয়া। বলতে পারি এ হলো প্রেমকাব্যের প্রবেশিকা বা মুখবন্ধ। অথচ প্রেমিক অহংকারী। সে নিজেকে ভাবে তার মতো প্রেমিক আর হয় না। তার চেয়ে কে বেশি ভালোবাসতে জানে? কেই বা এমন ফালি ফালি হয়, পোড়ে তীব্র অনলে! ভালোবাসা শব্দের বিপরীত শব্দ কি? আপনি বলবেন, ঘৃণা। যুক্তি সেটাই বলবে। কেউ বলতে পারেন উপেক্ষা, কিংবা উদাসীনতা। অপ্রেমও বটে। আমাদের প্রেমিক কবি প্রয়াত সৈয়দ হক বলছেন ‘মৃত্যুদণ্ড’। ছোট্ট কবিতার পুরোটা পড়া যাক :
আমার নামের মানে রবি হয়, অথবা মার্তণ্ড।
যে যেমন দেখে থাকে প্রেমে কিংবা ক্রোধে।
কারো কাছে ভালোবাসা কারো কাছে প্রাণদণ্ড
দুটোই গ্রহণ করি পুরস্কারবোধে।
প্রাণদণ্ড তুমিই দিয়েছো!
ভালোবাসা? সেও তুমি তুমিই দিয়েছো॥
আচ্ছা প্রেমের কবিতার বেলায় অন্ত্যমিল কি জরুরি? না, জরুরি নয়। মানে অপরিহার্য শর্ত নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রেমের যে কবিতাগুলো আমাদের মনের ভেতর খোদিত হয়ে আছে, যেগুলো বহুল পঠিত, আবৃত্তিকারদের বাছাই-তালিকার শীর্ষে সেগুলোর বেশির ভাগই পারফেক্ট ছন্দে লেখা এবং তাতে রয়েছে মধ্যমিল অন্ত্যমিল। মিল মানেই সংগীতই তাতে বেজে বেজে ওঠে। কবিতায় এই যে গীতলতা এসে প্রেমের পঙক্তিকে বাজিয়ে দিয়ে যায়, এটা ওষ্ঠের উচ্চারণ ও শ্রুতির সংবেদনের জন্য আরামপ্রদ। কবিতাগ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদের ছ’পঙক্তির ছলটুকু চেখে দেখা যাক। ছটি চরণে একই মিল পাঠককে ধন্দে ফেলে দেওয়ার কৌশল এ কোনো নবীন কবির রচনা নয় কি? ওই উচ্চারণ নবীন প্রেমিকের তো বটেই। তাই এমন কৌশল পাঠককে আরো কৌতূহলী করে তোলে অনাঘ্রাত রসাস্বাদনের আকাঙ্ক্ষায়।
ভালোবাসার জলে আমার তোমার সঙ্গে নাওয়া
আমি তোমার আদম, তুমি আমার পাশে হাওয়া।
তোমার পাশেই এখন আমার বেহেশতকে পাওয়া
প্রচ্ছদ-পার্শ্বে (ব্লার্বে) চৌদ্দ মাত্রার অক্ষরবৃত্তের অন্তমিল লক্ষ্য করা যাক:
তুমি যে সেজেছো লাল সোনালি শাড়িতে,
রাজপথে নয় যেন বিয়ের বাড়িতে
আমার হৃদয় ভেঙে বাজে যে শানাই
সারাদিন শুনি আমি, তুমি শোনো নাই
যখন আকাশ ক্রমে লাল হয়ে ওঠে
তখন সোনালি শব্দ ‘ভালোবাসা’ ফোটে
তারায় তারায়, চাঁদ ধরায় আগুন।
তখন শানাই পায় ইমনের ধুন॥
সহজ মিলের (শাড়িতে/ বাড়িতে) মিছিলের শেষটায় গিয়ে প্রচলতাকে ভেঙে দেওয়া। শানাইয়ের বিপরীতে শোনো নাই আমাদের কানে চমক নিয়ে আসে। কিন্তু আগুন শব্দের সঙ্গে ‘ইমনের ধুন’ দিয়ে সূচনার সহজতাকে এক পলকে নিয়ে যান গভীর গহিনে।
এখানে কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছি যেগুলো তুলনা-উপমায়, ধ্বনিতে-উচ্চারণে বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র ও অভিনব। এমনভাবে কোনো বাঙালি কবির কলম বলে ওঠেনি। এই প্রাপ্তিগুলো অসামান্য, তাৎপর্যবহ।