সাধকের মতো নির্মোহ হওয়া দরকার : বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
গত ৭ নভেম্বর কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বাংলাদেশ সফরের অংশ হিসেবে এসেছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক সরকারি ইনস্টিটিউট। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় এক মতবিনিময় সভার। সভায় সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নির্মাতা, কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যা বলেছেন তা তুলে ধরা হলো পাঠকের সামনে।
বুদ্ধদেব বলেন, “বেশি সময় আমার হাতে নেই কথা বলার জন্য, এটা একটা অসুবিধা। পরবর্তী সময়ে নিশ্চয় আবার আসব দিন সাতেকের জন্য তখন নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হবে। এখন কিছু কথা বলি।
‘আপনারা সৌভাগ্যবান এ কারণে যে একটা ইনস্টিটিউটে পড়ার সুযোগ আপনারা পেয়েছেন। আমাদের কিন্তু এ রকম সুযোগ ছিল না। আমি পুনেতে পড়তে যেতে চেয়েছিলাম, আমার বাবা রাজি হননি। আমার খুব দুঃখ হচ্ছিল কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি এ কারণে যে আমার খুব পছন্দের বিষয় ছিল ইকোনমিকস। সে কারণে ইকোনমিকস নিয়ে পড়াশোনা করি, পড়াই। কিন্তু ছেড়ে দেই, ছেড়ে দেই এ কারণে যে সিনেমার প্রতি যে টান। সিনেম্যাটিক ভালোবাসাটা এসব ঘিরে আমার বেঁচে থাকাটাই ঠিকঠাক হবে না। প্রাণ দিয়ে সিনেমাকে ভালোবাসলে তাহলে কিন্তু কাজটা হবে নইলে হবে না।”
দীর্ঘকাল বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউ-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেখানে আর থাকেননি তিনি। ইনস্টিটিউট ও একাডেমিক শিক্ষা নিয়েও এ সময় কথা বলেন বুদ্ধদেব। তিনি বলেন, ‘আমি একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ছিলাম, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট। কিন্তু আমি স্টুডেন্টদের একটা কথাই বলতাম– আমি যখন সিনেমাকে ভালোবাসলাম, তখন আমার মনে হতো যে আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু শিখিনি। তখন আমার মন বলে দিল কীভাবে কী করা যায়, শেখা যায়। আমার মা ছোটবেলাতে দেখতাম অর্গান বাজাতেন, পিয়ানো বাজাতেন। ঢাকা শহরে পুরানা পল্টনে আমাদের মামাবাড়ি ছিল। আর মা মাঝে মাঝে আমাদের কবিতা পড়ে শোনাতেন। মা যখন বাজাতেন, চোখ বন্ধ করে শুনতাম। প্রচুর মিউজিক শোনার অভ্যেস আমার মাঝে গড়ে উঠেছিল এভাবে– ক্ল্যাসিকাল, বেসিক ক্ল্যাসিকাল, ফোক এরকম নানা ধরনের মিউজিক আপনি শুনবেন। দেখবেন যে প্রচুর ইমেজ আপনার চোখে ধরা দিচ্ছে। এগুলো সব যে ডেফিনেট, ডেস্ক্রিপ্টেড ইমেজ তা কিন্তু নয়, নন-ডেস্ক্রিপটেড ইমেজ পাচ্ছেন, অদ্ভুত ইমেজ পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এঁদের কিংবা প্রচুর লোককবি আছেন তাঁদের কবিতা পড়বেন। দেখবেন যে ছবি পাচ্ছেন। আর হচ্ছে পেইন্টিং। কলকাতায় তো বটেই, ঢাকাতেও অনেক এক্সিবিশন হয়। এখানেও বড় বড় শিল্পীরা বাস করেন। কাজ করেন। তাঁদের কাজ দেখবেন। একটা ভালো পেইন্টিং কিন্তু আপনাদের অনেক কথা বলবে। আমার একটা অভ্যেস ছিল যখনই হাতে পয়সা পেতাম পেইন্টিং-এর বই কিনতাম। ভালো পেইন্টিং কিন্তু আপনাদের অনেক কথা বলবে।’
‘দুই ধরনের ইমেজ হয়, একটা হচ্ছে ধার করা। বহুদিন ধরে চলে আসছে। আরেকটা হচ্ছে যেগুলো ভেতর থেকে নতুন করে তৈরি হচ্ছে। যেগুলো ধার করা নয়। সেগুলো খুঁজে বের করা। আর তারপর ফিল্ম দেখা তো আছেই। মাস্টারমশাইরা যা পড়াচ্ছেন, যে ফুল দিচ্ছেন সেটা গ্রহণ করা। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে মনে হয় যে খুব একটা কিছু বলার নেই আপাতত। আর একটা জিনিস মনে রাখবেন ইমেজের সঙ্গে সঙ্গে সাউন্ড। শব্দ! একটা দৃশ্যকে পূর্ণমাত্রা দিতে ভীষণভাবে সাহায্য করে শব্দ, যেমন – একটা ফুল রাখা হলো শব্দ হলো, কেউ চামচ নাড়ছে শব্দ হচ্ছে। এসব শব্দ ছাড়া আরো অনেক শব্দ আছে। যে শব্দগুলো ক্রিয়েট করতে হয়। যে শব্দগুলো এক্সিস্ট করে না। সেগুলো যোগ করলে দেখবেন যে মানটা বেড়ে গেছে।’
‘তুমি ছবি দেখছো, দৃশ্যেরা চলে যাচ্ছে। শব্দ হচ্ছে। কিন্তু তুমি জানো না মাঝখানে আরো অনেক সাউন্ড আছে, সেই সাউন্ডগুলো তুমি খুঁজে বের কর। আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন যখন আপনারা ছবি করতে যাবেন, প্রচুর চরিত্র থাকবে, বিভিন্ন মানুষ তারা একেকজন একেকরকম। কীভাবে তাঁদের সঙ্গে আপনি কথা বলবেন। একটা বাচ্চা আছে তাকে দরকার আপনার, একজন বয়স্ক মানুষ আছেন… কীভাবে কমিউনিকেট করবেন? কীভাবে বোঝাবেন কী চাই? দেখিয়ে দেবেন? সব সময় তা হয় না। আমার মনে আছে নেওয়াজ বোম্বেতে আমার বাড়িতে যখন দেখা করতে গেল, তখন তাকে আমি বললাম – নেওয়াজ কলকাতা এসো। নেওয়াজ সাতদিনের জন্য কলকাতা এলো, আমার মনে আছে তার সাথে আমি শুধু কথা বলতাম। কথা বলতাম আর ওকে কথা বলতে দিতাম। ধীরে ধীরে ও বুঝতে পারল কেন আমি ওকে কথা বলতে বলছি। সেই চরিত্রের সাথে ওর মিল ও নিজেই খুঁজে পেয়ে গেল। এই যে কেউ নারী কেউ পুরুষ বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব একেকজন একেক রকমভাবে আলোড়িত হয়।’
কথার ফাঁকে ফাঁকে সময় গড়িয়ে যায়। উঠতে হতে হবে বুদ্ধদেবকে। ইমেজ আর শব্দ নিয়ে কথা বলতে বলতেই বিদায় নিয়েছিলেন তিনি, ‘যে জিনিসগুলো দেখে এসেছো এতদিন তার বাইরেও কিছু তৈরি করা যায়, তার বাইরেও অন্য ধরনের ইমেজের কথা ভাবা যায়। তুমি তোমার মতো ভাবো। তখনই তোমার কাজ, তোমার সিনেমা অন্য কথা বলবে। তখনই মানুষ ভাববে এ তো অন্য কথা বলছে, ইমেজগুলো তো অন্যরকম। তখনই সেই ইমেজ বেঁচে থাকবে। আরেকটা কথা বলি, সিনেমার এ পথে অনেক প্রলোভন আছে, প্রলোভনের শেষ নেই। এ সমস্ত কিছু থেকে দূরে থাকতে হয়। সাধকের মতো নির্মোহ হওয়া দরকার। সত্য অর্থে সদর্থে নির্মাতা হয়ে বেঁচে থাকা দরকার। পুরস্কার পেতে খুব ভালো লাগে, পাবে, কিন্তু পুরস্কারে বিশ্বাস করবে না। না পাওয়ার ভয়, অসুখ, অতৃপ্তিটা আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। এই ভয় আমাকে সজাগ রেখেছে, মাথা নোয়াতে দেয়নি। এই ভয়কে আমি মান্য করি, মর্যাদা করি। আর কথা বলতে শুরু করলে তো থামা সম্ভব নয়। তবু আজ থামছি।’