‘বাবাই সিগারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন’

কিউবা নানা কারণে বিখ্যাত, সেগুলোর মধ্যে হাভানার চুরুট একটি। বিশ্বসেরা এই উপাদান বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে বিখ্যাতদের হাতে। যেমন সদ্য প্রয়াত বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট, কিংবদন্তি কাস্ত্রো ছিলেন এই চুরুটের দারুণ ভক্ত। ‘সিগার আফিসিয়ানাদো’ পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক মার্ভিন আর শাংকেন স্রেফ সিগার নিয়ে ফিদেলের সঙ্গে লম্বা আলাপের উদ্দেশ্য নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন হাভানায়। সেটা ১৯৯৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারির কথা। তবে সেই বিখ্যাত আলাপ সিগার ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা, ফিদেলের ভবিষ্যৎ—অনেক দিকেই গড়িয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি পরে ম্যাগাজিনের ‘সামার’ ইস্যুর কাভার স্টোরি হিসেবে প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত এই সাক্ষাৎকার ধারাবাহিকভাবে এনটিভি অনলাইনের পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে, আজ তার চতুর্থ পর্ব।
শাংকেন : যখন আপনি একটা ওয়্যারহাউজ বা রাস্তা বানান, সেটা বেশ কঠিন কাজ। তবে সে কাজটার পরিশ্রম আর সিগার বানানোর পরিশ্রম কিন্তু দুই ধরনের। সিগার যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা শিল্পকে গুরুত্ব দেন। যাঁরা ধূমপান করেন না, তাঁরা কিন্তু এটা ধরতেই পারবেন না যে তামাক চাষ আর সিগার প্রস্তুতের কাজে একই সঙ্গে কতটা পরিশ্রম আর প্যাশন জড়িয়ে থাকে…
কাস্ত্রো : তা তো বটেই!
শাংকেন : বহু বছর ধরেই মানুষ, পৃথিবীবাসী আপনাকে ছবিতে দেখেছে যে আপনি একটা সিগার হাতে ধরে রয়েছেন, অথবা সিগার ফুঁকছেন, ঠিক একটু আগে বা এখন যেমন ধরে রয়েছেন। (কাস্ত্রো তাঁর ডান হাতে একটি কোহিবা এসপ্লেনদিদো সিগার তুলে নিলেন)। প্রায় সাত-আট বছর হলো আপনি চুরুট ফোঁকা বাদ দিয়েছেন। আপনি কি সিগার মিস করেন না?
কাস্ত্রো : আপনাকে একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। আমি বেশ কম বয়সেই ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার বাবাও চুরুট ফুঁকতেন, আর তিনি ভালো চুরুট টানতে ভালোবাসতেন। বাবা ছিলেন স্প্যানিশ, গালিসিয়া থেকে এসেছিলেন। পুরোদস্তুর শহরতলীর মানুষ। আমার এখনো মনে পড়ে সেই দারুণ স্মৃতির কথা। আমি তখন কিশোর, হাই স্কুলে পড়ি। আমার বয়স ১৫। একদিন বাবার সাথে দুপুরের খাবার সারছি, তখন তিনি আমাকে চমৎকার একটা সিগার উপহার দেন। কাজেই বুঝতেই পারছেন, বাবাই আমাকে সিগারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমায় মদ কীভাবে খেতে হয় সেটাও শিখিয়েছিলেন…
শাংকেন : তাহলে তো বলতেই হয়, তিনি পানীয়-প্রেমী ছিলেন!
কাস্ত্রো : বাবা কিউবান সিগার ফুঁকতেন, আর ভালোবাসতেন স্পেনীয় মদ। আর দুটো বিষয়েই তিনি যথাযথ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি রিয়োহার ওয়াইন বেশ পছন্দ করতেন। বাবা সব সময়ই সিগার ফুঁকতেন, কালেভদ্রে সিগারেট। তবে আমি সিগারের অভ্যাসটা জারি রেখেছি। কাজেই আমি কৈশোর থেকেই সিগারখোর! ১৫ বছর বয়স থেকে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত আমি নিয়মিত সিগার ফুঁকেছি। আমার জীবনে দুটো ঘটনার সময় আমি ধূমপান করিনি। বিপ্লবের সময় চুরুটের উৎপাদনের বিরুদ্ধে ছিলেন কৃষক ও শ্রমিকরা, তারা কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুরো আন্দোলনটাই সিগার উৎপাদনের বিরুদ্ধে চলছিল। তখন সেই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতেই আমি কিছুদিনের জন্য সিগার ফোঁকা বন্ধ রাখি। এটা ছিল একটা ঘটনা। কিছুদিন পরই উৎপাদন আবারও চালু হয় পুরোদমে, আমিও দিব্যি ধূমপান শুরু করে দিলাম। এর পরে আমি সিগার ফোঁকা বন্ধ করি বাধ্য হয়ে, স্বাস্থ্যগত কারণে। আমাদের দেশের অনেক মানুষই ধূমপানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে আমার ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। আমি এ জন্য সিগার ছাড়িনি যে সিগার আমার পছন্দ নয়, সিগার আমার ভীষণ পছন্দের। আর আমার নেশাটাও ছিল বেশ। তবে সে সময়টায় পুরো দেশে একটা সামগ্রিক আন্দোলন হয়েছিল ধূমপানের বিরুদ্ধে।
শাংকেন : এটা কোন সালের কথা?
কাস্ত্রো : ঠিকঠাক তারিখ মনে নেই। ’৮৪ বা ’৮৫ সালের কথা হবে। ওহ্ না, মনে পড়েছে। এটা ছিল ২৬ আগস্ট, ১৯৮৫। এটা তখনই হয়েছিল যখন কিউবায় ধূমপানের বিষয়টা স্বাস্থ্যগত সচেতনতার একটা ইস্যু হয়ে পড়ল। ধূমপানের বিরুদ্ধে অনেকে কঠোর অবস্থান নিল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে প্রচারণার স্বার্থে আমি মানুষজনের সামনে ধূমপান না করার চেষ্টা করব, তবে আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দেইনি এ বিষয়ে। আমি তো সব সময়ই মুখে একটা সিগার নিয়ে চলতে অভ্যস্ত। জ্বলন্ত সিগার আমার সব সময়ের সঙ্গী। আমি যখন বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠক করি, তখনও সিগার ফুঁকি। ছবিতে বা টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে আমাকে দেখা যায় যে আমি সিগার ফুঁকছি। এমন অবস্থায় যদি আমাকে এভাবে ধূমপান করতে দেখা যায়, তাহলে ব্যাপারটা তো সুবিধের হবে না! তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে ধূমপানের বিরুদ্ধে ভালোভাবে প্রচারণা করতে হবে, আর সে জন্য একটা বড় উদাহরণও স্থাপন করতে হবে—নিজেরই ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। সে কারণেই ধূমপান বন্ধ করেছিলাম। যেহেতু আমার উদ্দেশ্য ছিল খুবই বড়, তখন সিগার ছাড়াটা তত কঠিন লাগেনি। মানুষজন আমাকে জিজ্ঞেস করত যে আমি যখন একলা থাকি তখন সিগার ফুঁকি কি না! সবার কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হতো যে এতটা বছর পর আমি কীভাবে সিগার ছাড়া থাকতে পারি! অনেকেই ভাবত, নিশ্চয়ই আমি বাসায় বসে সিগার ফুঁকি!
(চলবে…)