‘বাংলাদেশ’ গানটা লিখেছিল জর্জ : রবিশঙ্কর

[নিউইয়র্ক। ডেটলাইন ১ আগস্ট, ১৯৭১। সদাব্যস্ত ম্যানহাটন এলাকার ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে রচিত হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর বিটলসের লিড গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে আয়োজিত এই কনসার্টে জমায়েত হলেন ৪০ হাজার শ্রোতা-দর্শক। যুদ্ধগ্রস্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সাহায্যার্থে এবং এর প্রতি বিশ্ববাসীর সচেতনতা সৃষ্টিতে এ ছিল এক অসামান্য উদ্যোগ। এই কনসার্টের পারফরম্যান্স নিয়ে বের হওয়া লাইভ অ্যালবামটি বেস্টসেলার হয় এবং গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়; পরবর্তীকালে এই কনসার্ট অবলম্বনে একটি প্রামাণ্যচিত্র বড়পর্দায় মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে।
অসামান্য এই সংগীতায়োজনে অংশ নিয়েছিলেন কিংবদন্তি সব সংগীতশিল্পী। রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও ছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন, রিংগো স্টার, বব ডিলান, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ আল্লারাখা খাঁ, কমলা চক্রবর্তীর মতো বিখ্যাত শিল্পীরা।
ইউনিসেফের এক বিশেষ উদ্যোগ ‘দ্য জর্জ হ্যারিসন ফান্ড’-এর জন্য এই কনসার্টের বিষয়ে একটি বক্তব্য তৈরি করে দেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এই বক্তব্য পরে জর্জ হ্যারিসন ফান্ডের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে যোগ করা হয়। এ বক্তব্যের মাধ্যমে পুরো আয়োজনের উদ্দেশ্য এবং তৎকালীন পরিস্থিতির সবটাই ফুটে ওঠে চমৎকারভাবে। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ভাষান্তর করা হলো রবিশঙ্করের সেই বক্তব্যটি।]
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের কথা। আমার নিজ ভূমি বাংলায় মানবতার সংকটের খবর পেলাম। আমার বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের পরিস্থিতি আমাকে নাড়িয়ে দিল। অজস্র শরণার্থী আর হাজার হাজার ছোট্ট শিশুকে সাহায্য করার প্রয়োজন বোধ করলাম আমি তীব্রভাবে।
আমার চিন্তা নিয়ে কথা বললাম জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। ও বুঝতে পারছিল, আমার মনের মধ্যে কেমন তোলপাড় চলছে। সেখান থেকেই ফান্ড তৈরির জন্য একটা কনসার্ট আয়োজনের চিন্তার শুরু। এই কনসার্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাওয়া গেছে। আমার প্রিয় জর্জের সাহায্য ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। যা ঘটেছে (এই আয়োজন) তা এখন ইতিহাস, এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম সংগীতায়োজনের মধ্যে এটি একটি।
আমাকে বারবারই জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, কোন কনসার্টের স্মৃতি আমাকে সবচেয়ে নাড়া দেয়? এটা মনে করে ওঠা খুবই দুষ্কর, আমার ক্যারিয়ারটাও তো ৭৫ বছরের! তবে এটা ছিল আলাদা কিছু! কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আমার জন্য সব সময়েই আলাদা কিছু। এই আয়োজনের চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছিল এমন একটা সময়ে, যখন আমার খুব কাছের মানুষের সাহায্য দরকার ছিল।
আলী আকবর খাঁ আর আল্লারাখা স্টেজে আমার সঙ্গে প্রথমার্ধে পারফর্ম করেছিল। জর্জ হ্যারিসন পারফর্ম করেছিল দ্বিতীয়ার্ধে। ওর সঙ্গে ছিল বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিংগো স্টার, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেলের মতো সে সময়ের নামজাদা সব সংগীতশিল্পী। জর্জ কনসার্টটা শেষ করেছিল ‘বাংলাদেশ’ গানটি গেয়ে। কেবল এই আয়োজনের জন্যই ‘বাংলাদেশ’ গানটা লিখেছিল জর্জ।
এর ফলে রাতারাতি ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি দেশের নাম জেনে গেল পুরো দুনিয়া! মিলিয়নের পর মিলিয়ন ডলার পেলাম আমরা, ইউনিসেফকে টাকাটা দিয়ে দেওয়া হলো শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। তারা শরণার্থীদের দুধ, কম্বল আর কাপড় বিতরণ করেছিল।
৫৩ বছর পরও এই কনসার্ট আজও মানুষ এভাবে স্মরণে রেখেছে, এ ব্যাপারটা আমার মন ছুঁয়ে দিয়েছে খুশিতে। এই অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের শিশুরা জর্জ হ্যারিসন ফান্ডের সহায়তা পাবে। আজকের দিনের শ্রোতাদেরও এই দুর্দান্ত কনসার্টের অসাধারণ গানগুলো ভালো লাগবে—এ আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি।