গুলিস্তান
যে সিনেমা হলের নামে পরিচিত হলো ঢাকার প্রাণকেন্দ্র
রাজধানী ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত ও জনবহুল সড়ক সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত ‘গুলিস্তান’। ট্রাফিক, হকার, পথচারী আর যানবাহনের কোলাহলে ২৪ ঘণ্টা মুখরিত থাকা এই স্থানটির নামের পেছনে রয়েছে এক চমৎকার ইতিহাস। ফার্সি ভাষা থেকে আসা ‘গুলিস্তান’ শব্দের অর্থ ‘ফুলের বাগান’ হলেও, সরকারিভাবে এমন কোনো স্থানের অস্তিত্ব নেই। এই বিশেষ নামকরণটি হয়েছে মূলত এখানকার একটি বিখ্যাত সিনেমা হলের নাম থেকে।
নামকরণের আড়ালে এক প্রেক্ষাগৃহের গল্প
শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত 'ঢাকাকোষ' অনুযায়ী, গুলিস্তান সিনেমা হলের নামানুসারেই এই পুরো এলাকাটি 'গুলিস্তান' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকে এই এলাকাটি ছিল ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। চলচ্চিত্রবিষয়ক সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ-এর তথ্যমতে, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতার চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজল আহমেদ দোশানি ঢাকায় আসেন। তিনি ১৯৫৩ সালে রমনার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উত্তরে এবং পল্টন মাঠের পাশে 'গুলিস্তান' নামে একটি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করেন।
এই প্রেক্ষাগৃহটি ছিল ঢাকার প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ। প্রথমে এর নাম ছিল 'লিবার্টি', পরে তা পরিবর্তন করে 'গুলিস্তান' রাখা হয়। আগা খান এই সিনেমা হলের উদ্বোধন করেছিলেন।
পুরাতন ঢাকার স্মৃতি নিয়ে লেখা 'ঢাকাপুরাণ' গ্রন্থে মিজানুর রহমান লিখেছেন, সেই সময় গুলিস্তান সিনেমার উল্টোদিকে ছিল ব্রিটানিয়া হল। তখন পুরো এলাকাটিই ছিল ন্যাড়া, ঘরবাড়ি বলতে তেমন কিছু ছিল না; কিছু ক্লাবঘর, এসএ গ্রাউন্ড আর সবুজ মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল এই একরত্তি সিনেমা হল।
১৯৫৫ সালে গুলিস্তান হলের ওপর তলায় ‘নাজ’ নামে আরেকটি সিনেমা হল চালু হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই গুলিস্তান এলাকাটি চলচ্চিত্র এবং শিল্প-সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল।
বর্তমানের রূপ ও জনজীবনের কেন্দ্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গুলিস্তানের মালিক পাকিস্তানে চলে গেলে হলটি পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে এটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে আসে। ২০০৫ সালে পুরনো ভবনটি ভেঙে একটি নতুন শপিং কমপ্লেক্স স্থাপন করা হয়।
বর্তমানে গুলিস্তান একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত, যা এটিকে ঢাকা শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত ও জনবহুল কেন্দ্রে পরিণত করেছে। সড়কের দুই পাশে রয়েছে অসংখ্য পাইকারি ও খুচরা দোকান, যা দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাকের যোগানদার। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনায় মুখরিত এই স্থানে ঢাকা শহরের অন্যতম প্রাচীন পরিবহন 'টমটম' এখনও দেখা যায়।
এখানে রয়েছে 'গোলাপ শাহের মাজার', যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভক্তি প্রদর্শন করেন। এছাড়া, বঙ্গবাজার এখানে কম মূল্যে নতুন পোশাকের জন্য অন্যতম প্রধান কেনাকাটার স্থান।
যানজট কমাতে এবং ভ্রমণ সময় কমাতে ২০১৩ সালের অক্টোবরে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক নির্মিত হয়। গুলিস্তানের সন্নিকটেই রয়েছে ওসমানী উদ্যান পার্ক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়, ঢাকা জিপিও, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এবং বায়তুল মোকাররমের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
এক সময়ের 'ফুলের বাগান' এবং আধুনিক প্রেক্ষাগৃহের নাম ধারণ করে 'গুলিস্তান' আজও ঢাকার গতিময় জনজীবনের প্রধানতম কেন্দ্র হিসেবে নিজের গুরুত্ব ধরে রেখেছে।

ফিচার ডেস্ক