ঋত্বিক ঘটক : উজানে গুণ টানা সেলুলয়েড মাঝি
‘অন্যদের মতো আমি সিনেমার লোক নই মশাই। আমি কিছু একটা বলতে চাই। সিনেমার লোক তারাই যারা জীবনযুদ্ধে পরাজিত। অন্তত মানসিকভাবে। যাদের নিয়ে একমনে সংগ্রামে নেমেছিলাম তারা সবাই আজ সরে দাঁড়িয়েছেন। তারা পরাজিত। তারা সিনেমার লোক হয়ে গেছে। আমি কম্প্রোমাইজ করিনি। কোনোদিন করবও না।’
ক্ষ্যাপাটে এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁর পারিবারিক কৌলীন্য। সৃষ্টিশীল এই মানুষটির জন্ম এক ধ্রুপদী পরিবারে। সমাজের উঁচু স্তরে জন্ম নিয়েও আজীবন শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য লড়ে গেছেন কলম, মঞ্চ ও সেলুলয়েডকে হাতিয়ার করে। এই মহান মানুষটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমাদের দেশেই। পাবনার ভারেংগা গ্রামে ঋত্বিক ঘটকের মূল বাড়ি। পিতার চাকরিসূত্রে ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনের ঝুলন বাড়িতে জন্ম হয়েছিল দুজন ছেলেমেয়ের। এদের একজন পরবর্তী জীবনে স্বনামধন্য ঋত্বিক কুমার ঘটক। অন্যজন সাত মিনিটের ছোট প্রতীতি দেবী।
বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক, মা ইন্দুবালা দেবী। নয় ভাইবোনের মধ্যে ঋত্বিক ও প্রতীতি সবার কনিষ্ঠ। বাবা ঋত্বিককে আদর করে ডাকতেন ‘টেক বাহাদুর’ এবং ‘ভবা’। তাঁর স্কুলজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে। এরপর রাজশাহীতে শিক্ষা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান। মূলত এখানেই ঋত্বিকের ঋত্বিক হয়ে ওঠা।
সাহেবীয়ানার প্রতি ছিল তাঁর তীব্র ঘৃণা। ছোটবেলা থেকেই বাঁশি বাজানো, ছবি আঁকা, গল্প লেখা ও অভিনয় নিয়ে মেতে থাকতেন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নানার তৈরি রাজশাহী গণগ্রন্থাগারের সব বই পড়ে ফেলেন! ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গণগ্রন্থাগারে নাটক ‘অচলায়তন’ মঞ্চস্থ করেন। সেখানে থাকাকালীন রাজনীতিতে সরাসরি না জড়ালেও স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। তখন টগবগে রক্ত, ইমিডিয়েট রিঅ্যাকশন চাই। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য লেখালেখি শুরু করেন, প্রচুর গল্প লিখেন।
তাঁর ভাষ্যমতে পঞ্চাশটির বেশি গল্প লিখেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জ্বালা, চোখ, কমরেড, গাছ, আয়নান্ত, আকাশ গংগা, দলিল, বিসর্জন ইত্যাদি। সেসময় তাঁর গল্প প্রকাশ হয় দেশ, অগ্রণী ও শনিবারের চিঠিতে। বেশির ভাগ গল্পেই এসেছে দেশভাগ, কাঁটাতার, দুই বাংলার বাস্তুচ্যুত মানুষের কথা। আছে প্রেম। কোনো কোনো গল্প নিছক কবিতাও। সেই সময়ে নাটক নবান্ন মঞ্চস্থ হলো। নবান্ন তাঁর সমস্ত জীবনধারা পাল্টে দিলো। তিনি তখন নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু কোথাও যেন স্বস্তি মিলছে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। যোগ দেন কলকাতার আইপিটিএ-তে। শুরু করেন গণনাট্য আন্দোলন। পাশাপাশি সেলুলয়েডকে হাতিয়ার করে শ্রেণিবৈষম্য ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
তৎকালীন শিল্প সংস্কৃতির সূতিকাগার কলকাতায় গমন যেমন ছিল অবধারিত তেমনি দেশভাগ, দাঙ্গা ও পিতা-মাতা বিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে এখানে ফিরে না আসাটা একরকম বাধ্য হয়েই। কিন্তু আমৃত্যু তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিকর্মে এই মাটির প্রতি নিরন্তর ভালোবাসা ও পক্ষপাতের নিদর্শন রেখে গেছেন। তিনি বলেন- ‘আমার সমস্ত বাংলাকে ভালোবাসার মূল হচ্ছে পূর্ব বাংলা। নিজেদের ষোলআনা সুবিধের জন্য জোচ্চুরি দ্বারা যে দেশ ভাগ করা হলো, তার ফলে আমার মতো প্রচুর বাঙালি শেকড় হারিয়েছে। এ দুঃখ ভোলার নয়। আমার শিল্প তারই ভিত্তিতে।’
দেশভাগের পর ফিরে না আসার কারণে ঋত্বিক হয়ে গেলেন ভারতীয়। আজ বিশ্বময় ঋত্বিক ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি দেখলে বা পড়লেই বোঝা যায় ঋত্বিক কী? যে কয়েকটি নাটকের জন্য ঋত্বিকের নাম নাট্য আন্দোলনে চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছে তার একটি দেশভাগ ও উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে নাটক ‘দলিল’। ১৯৫২ সালে নিজের লেখা সেই নাটকটি নিয়ে তিনি বোম্বে পাড়ি দিলেন গণনাট্যের কনফারেন্সে। সেই সময় বোম্বেতে বিমল রায়ের ‘মধুমতি’ ও ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’-এর চিত্রনাট্য লিখে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কিন্তু শুধু পয়সা আর জনপ্রিয়তার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করা মোটে ও পছন্দ করতেন না। তাই সেসব ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। ‘নাগরিক’ যন্ত্রণা তখনো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
১৯৫২ সালে নাগরিক সিনেমার কাজ শেষ হলে ও তা তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকারের হস্তক্ষেপে আলোর মুখ দেখেনি। বেকার যুবক রামুর ঘর বাঁধার স্বপ্নের ছবি ছিল ‘নাগরিক’। ঋত্বিকের ছোট বোন প্রতীতি দেবীকে সত্যজিৎ রায় এক অনুষ্ঠানে বারবার বলেছিলেন ‘তখন যদি ওই ছবি নাগরিক দেখানো হতো, তাহলে ঋত্বিকের আগে ভারতবর্ষে আর কারো নাম উচ্চারিত হতো না।’ বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে ক্ষণজন্মা ঋত্বিক ঘটক হাত দিলেন পরের ছবি সুবোধ ঘোষের কাহিনি অবলম্বনে ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমায়। চরিত্র বলতে জগদ্দল আর বিমল।
অযান্ত্রিক মুক্তি পেল, উচ্ছ্বসিত দর্শক। জনপ্রিয় হলো পরের সিনেমা শিবরাম চক্রবর্তীর ছোটগল্প অবলম্বনে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। ছিন্নমূল মানুষের কলোনিতে ফের তাঁর ক্যামেরা ধরল ক্ষয়িষ্ণু জীবন। এবার শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনি নিয়ে শুরু করলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’। সেই সিনেমার সেন্সর হচ্ছে। বোর্ডের সদস্য তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়। ছবি দেখে বের হয়ে ঋত্বিককে তিনি বললেন ‘মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা ছাড়া কি আর ছবি হয় না? তার উত্তরে ঋত্বিক বলেন, ‘আপনার কাছে যা বাস্তব, তা হয়তো আমার কাছে নয়।’
এরপর একে একে তৈরি করলেন কমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা। নাট্য আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির অনেকের সাথে তাঁর মতবিরোধ দেখা দিলো। অনেকে তাকে বয়কট করল। কিন্তু জীবনের কোনো স্তরে তিনি বিন্দুমাত্র আপস করেননি। ফলে হারিয়েছেন বন্ধু, সহকর্মী, কখনো বা পারিবারিক আশ্রয়। অর্থ, যশ, খ্যাতি তাকে কখনো প্রলুব্ধ করেনি। বরং তাচ্ছিল্যের সাথে এসব জাগতিক মোহ উড়িয়ে দিয়েছেন এক ফুৎকারে। জীবনের দুঃখ এবং গ্লানি ভোলার জন্য হতাশাচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত সমাজে আ্যালকোহলিজমের শিকার হয়ে যান এই শিল্পসাধক। রাগে অভিমানে নিজের শরীরের ওপর প্রতিশোধের মাত্রা বাড়িয়ে দেন, ভেঙ্গে পড়ে শরীর। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন। এরমধ্যে কিছুটা সুস্থ হলে ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রিন্সিপাল পদে দায়িত্ব পালন করেন। এমন অসুস্থতা সঙ্গে নিয়ে করলেন শেষ দুটি ছবি।
স্বাধীন বাংলাদেশে এসে করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আর ওপার বাংলায় করলেন ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’। তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমাটি নিয়ে তাঁর আগ্রহ আর উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। সবটুকু দরদ ঢেলে তিনি ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। বস্তুত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে-কজন মুষ্টিমেয় জীবনবাদী চলচ্চিত্রকারের সাধনায় বাংলা ছবি আজ গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত, তাদের প্রথম সারিতে রয়েছে তাঁর স্থান। স্বীয় প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অর্জন করেছেন পদ্মশ্রী ভূষণ।
‘মশাই আমার শত্রু অনেক। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঁচব কী নিয়ে! চারদিকে শুধু হতাশা, বিদ্বেষ, প্রতারণা, বঞ্চনা, যে প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে মহা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলাম একদিন, তারা যে শুধু আমাকে নিরাশই করছেন তা নয়, তারা আজ শত্রুতাই করছেন। আমি জানি আমার অপরাধের কথা। তবু একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমি আজও মরে যাইনি। মরার আগে আমি প্রমাণ করে দিয়ে যাব আমার চারপাশের জনতার চাইতে আমি অন্যরকম।’ সময়ের এই নিঃসঙ্গ বেণুবাদক ভাঙা দেশ, উদ্বাস্তু জীবন, বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের গল্পকে নিজের মতো করে বলেছেন গল্পে, মঞ্চের সংলাপে, সেলুলয়েডের ফিতায়। কান পাতলেই সুবর্ণরেখার তীরে তার সুর শোনা যায়- চলো, থেমে থেকো না।
লেখক : চিত্রগ্রাহক ও নির্মাতা

সোয়েব আহমেদ