নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদকে কতটা মনে রেখেছেন?
এক জীবনে বইপড়ুয়াদের যে স্রোত তৈরি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ, তাতে ভেসে সর্বস্তরের পাঠকরা আনন্দ স্নানে মত্ত থেকেছেন, আজও আছেন। বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের মাঝে অবধারিতভাবে চলে আসছে হুমায়ূন সাহিত্যের প্রভাব। তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। একটা ধারা যখন চালু হয় এবং সাহিত্যে তা প্রভাবক হয়ে দাঁড়ায় এমনকি লেখক চলে যাবার পরেও, তা নিয়ে রটনা না রটাই বরং অস্বাভাবিক।
হুমায়ূন আহমেদ কি কেবল একজন কথাসাহিত্যিক? কেবল লেখকের গন্ডিতে তাকে আটকে রাখলে অন্যায় হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। অবদান রেখেছেন শিল্পের আরও দুটো জায়গায়। নির্মাণের মুন্সিয়ানা তিনি দেখিয়েছেন নাটক ও চলচ্চিত্র দুই ক্ষেত্রেই। ’কোথাও কেউ নেই’ নাটকের শেষ পর্বের কথা কারও অজানা নয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অনুরোধেও তিনি বদলাননি বাকের ভাইয়ের ফাঁসির দৃশ্য। বাংলা নাটকের ইতিহাসে একমাত্র চরিত্র বাকের ভাই, যাকে বাঁচাতে মানুষ রাস্তায় নামে। কতটা আপন করেছিল, ভাবা যায়!
এর বাইরে আরেকটি ভাবনা উঁকি মারে অবচেতনে, কতটা সুগভীর নির্মাণ হলে এতটা বিদ্রোহ সম্ভব? এরপর আসে আজ রবিবার, অয়োময়, বহুব্রীহির মতো কালজয়ী নাটক। যেগুলো আধুনিক নির্মাতাদের জন্য পিওর কেইস স্টাডি! লেখালেখি, নাটক নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সিনেমায় আসেন ভিন্নতা নিয়ে। অনেকের মতে ’অর্ডিনারি লেখক’ হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে মোটেই অর্ডিনারি ছিলেন না।
বইয়ের আদলে তৈরিকৃত সিনেমাগুলো সাধারণত বইকে খুব একটা ছাড়িয়ে যেতে পারে না। এর অন্যতম কারণ, বইয়ের লেখক নিজে সিনেমা বানান না। তা ছাড়া দর্শক চাহিদা, সময়ের কথা মাথায় রেখে প্রযোজক-পরিচালক তাতে পরিমার্জন করেন। সংযোজন বিয়োজন নামক ছুরি-কাঁচির নিচে পড়ে চলচ্চিত্র কখনও আবেদন হারায়, কখনও আবার ছাড়িয়ে যায় মূল বইকে।
পথের পাঁচালি, সাইল্যান্স অব দ্য ল্যাম্বস, দ্য গডফাদার এক্ষেত্রে মূল বইয়ের সাথে টক্কর দেওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি তারই উপন্যাস অবলম্বনে। তার সবচেয়ে বড়ো সুবিধা যেটি, যার সুফল ভোগ করেছে দর্শক, তা হচ্ছে নিজের কাজ নিজে করেছেন। এতে কখন কী প্রয়োজন তা সর্বোচ্চ সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তুলতে তিনি সক্ষম।
সত্যজিৎ রায় নিজের চলচ্চিত্রের পোস্টারও নিজে তৈরি করতেন। তিনি মনে করতেন, যে ভাবনা তার মাথায় উঁকি মারছে তা অন্য কাউকে বোঝাতে চাইলেও পুরোপুরি বোঝাতে পারবেন না। হুমায়ূন আহমেদের ভাবনাও এখানে একই মোহনায় মিলে যাওয়ায় বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, আমার আছে জল, ঘেটুপুত্র কমলার মতো দুর্দান্ত সব চলচ্চিত্র।
বাংলাদেশের বড় অংশজুড়ে একাত্তর। একাত্তর ছাড়া আজকের স্বাধীন ভূ-খন্ড আমরা পেতাম না। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, আগুনের পরশমণির মতো সৃষ্টি দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ শক্তিশালী অবস্থান গড়েছেন পাঠক হৃদয়ে। রূপালি পর্দায় অভিষেক ঘটান মুক্তিযুদ্ধের ছবির মাধ্যমে। হালফিলে আমাদের দেশে যেসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়, গুটিকয়েক বাদে বাকিগুলোকে চলচ্চিত্র না বলে প্রহসন বলা উত্তম। পোশাক থেকে শুরু করে শ্যুটিং সেটের অবস্থা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে, অহেতুক গাধাকে পিটে ঘোড়া বানানোর অপচেষ্টা কেনো করছে এরা? সেখানে হুমায়ূন আহমেদের আগুণের পরশমণি কিংবা শ্যামল ছায়া বাংলাদেশের অন্যতম সেরা যুদ্ধকেন্দ্রিক সিনেমা হিসেবে অবধারিতভাবে উচ্চারিত হবে সবার মুখে।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। নানা ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। দুইভাবেই দেখেছেন একাত্তরকে। দেশপ্রেমের কাছে সব তুচ্ছ, সেটি তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শ্যামল ছায়াতে দর্শককেও উপলব্ধি করালেন। দেশপ্রেম জেগে ওঠা শান্তি কমিটির একজন কমান্ডার যুদ্ধাহত একটি নৌকা ও এর যাত্রীদের বাঁচান। সেই নৌকাতে আবার মুসলমান হিন্দু একসাথে সফর করে। সাধারণ মুসলিম অথবা হিন্দু হলে চোখে পড়তো না, কিন্তু একই নৌকা ভাগাভাগি করে আছে মৌলভী ও গোঁড়া হিন্দু। যখন জানবেন, অস্প্রদায়িকতার মোড়কে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্ম রীতিমতো ঢাল, সেখানে এমন কিছু সাহসিকতার প্রতিচ্ছবিই বটে। যেখানে একাত্তরে হিন্দুদের নিপীড়িত হবার পাল্লা ভারী।
রসায়নের অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদের শিল্পীদের সঙ্গে রসায়ন ছিল চমৎকার। চিত্রনাট্য নিয়ে আলোচনা করতেন শিল্পীদের সাথে। আসাদুজ্জামান নূর বলেছিলেন, ‘তিনি আমাদের সঙ্গে চিত্রনাট্য ও বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতেন, পরামর্শ চাইতেন। যদিও, আগে থেকে সম্পাদিত তার নিখুঁত কর্মে আমরা সংযোজন বিয়োজন করতে পারতাম না। সেই জায়গাটা তিনি রাখতেন না। তবু, পরামর্শ চাইতেন।’
চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ কতটুকু মূল্যায়ন পেয়েছেন? প্রথম ছবি আগুনের পরশমণি তাকে এনে দেয় শ্রেষ্ঠ সংলাপ, চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র, মোট তিন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সর্বশেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলার জন্য পান শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
শুরু ও শেষ একই রেখায় আঁকা। মাঝের সময়টায় দুহাত ভরে দিয়েছেন। কখনও নিজে, কখনও অন্যের হাত ধরে। তারই উপন্যাস অবলম্বনে মোস্তাফিজুর রহমানের শঙ্খনীল কারাগার, তৌকির আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ, মোরশেদুল ইসলামের প্রিয়তমেষু ছবিগুলো হয়েছে দারুণ প্রশংসিত।
আসা যাক বাংলা চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদের অবদানে। মোট আটটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন। এতেই নির্মাতা হিসেবে নিজের মুন্সিয়ানার ষোল আনা প্রয়োগ ঘটান। তার ছবিগুলো নিয়ে তরুণ নির্মাতারা বসতে পারেন। আগামীর দিনগুলিতে নির্মাণ নিয়ে ভাবছেন যারা, তাদের জন্য তিনি হতে পারেন দিক নির্দেশক।

জহিরুল কাইউম ফিরোজ