নীলফামারীর আনোয়ারের শেকলে বাঁধা জীবন
‘বাবা গো আমার ছেলেটারে ভালো করাতে চাই। সে যেন ভালো থাকে। আর ঘরে শেকলে বেঁধে রাখতে চাই না। আমরা আর কদিন বাঁচমু। কে দেখবে ওকে। কী হবে তখন ওর।’
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার উত্তর তীতপাড়া ভাটিয়াপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ঘরের ভেতর খুঁটি ব্যবহার করে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে আনোয়ারকে। সাংবাদিক দেখে এভাবেই হাউমাউ করে কেঁদে সন্তানের জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন মা আনোয়ারা বেগম (৬০)।
আনোয়ারা বেগম বলেন, আনোয়ার হোসেনকে (২২) পাঁচ বছর ধরে ঘরের ভেতর শেকলে বেঁধে রাখতে হচ্ছে। উলঙ্গ থাকে, চকিতে (বিছানা) থাকে না। বালিশ নেয় না, রাতেও ঘুমায় না। রাতের বেলায়ও উঠে উঠে তাকে দেখি। ভোরে উঠে দরজা খুলে দেই। কি যে কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছি আল্লাহ মাবুদেই জানেন।
পরিবারের তিন সদস্যের মধ্যে ছেলে আনোয়ারের পাশাপাশি বাবা মজিবর রহমানও অসুস্থ দীর্ঘদিন ধরে। লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করেন কোনোভাবে। আর মা একমাত্র সুস্থ ব্যক্তি। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। দুটি গরু ও দুটি ছাগল লালন-পালন করে সংসার চালাতে হয় তাঁকে।
বাবা মজিবর রহমান বলেন, আমার দিন শেষ। চলতে পারি না, হাঁটতে পারি না। বাঁধা থাকলেও ওর কাছে যেতে পারি না। আমি ওকে সামলাতে পারি না।
সে তো স্বাভাবিক মানুষ নয়। আমরা মরে গেলে সে কীভাবে থাকবে। কী করবে! সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই তাকে যেন সুস্থ করে তোলার উদ্যোগ নেয়।
বাবা মজিবর আরও বলেন, নিজের চিকিৎসা করাতে পারি না। ঠিকমতো তিনবেলা খেতে পারি না। ওই ছেলেকে সুস্থ করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?
প্রতিবেশি জহিরুল ইসলাম বলেন, এর আগে কয়েকবার নিখোঁজ ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া যায়। ভারত সীমান্ত পর্যন্ত গিয়েছিল। মাইকিং করে তার সন্ধান পাওয়া যায়।
ছোটবেলা থেকে বোঝা যায়নি। যখন ১০-১২ বছর বয়স হলো তখন থেকে তার অস্বাভাবিকতা বাড়তে থাকে।
আরেক প্রতিবেশি আকলিমা বেগম বলেন, এই পাঁচ-ছয় বছর আগে যখন ওর পাগলামি বেড়ে যায়, তখন ওর মা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা শুরু করল। তা ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। বেঁধে না রাখলে কোথায় যাবে, কী করবে। কাকে মারধর করবে। বিভিন্ন জিনিস নষ্ট করবে। দেখার তো মানুষ নাই। এজন্য এখন ঘরে বেঁধে রাখে ওর মা।
প্রতিবেশী জয়নব বেগম বলেন, যে ঘরে বেঁধে রাখে সেখানকার মাটি খুঁড়ে গর্ত করে ফেলে। ওর মা সিমেন্ট মাটি এনে একটু পাকার মতো করে দিছে। এর উপর থাকে সে। যেভাবে সে থাকে এটি মানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ না।
আনোয়ারের বন্ধু আইসক্রিম বিক্রেতা রজব আলী বলেন, আমরা একসাথে ক্লাস টুতে পড়েছিলাম। পাগলামির কারণে আর পড়তে পারি নাই। ঘরের বাইরে যখন শেকল দিয়ে বাঁধা থাকত গাছের সাথে, ওর সামনে দিয়ে যে যেত তাকে পা দিয়ে মারত। এক হাত খোলা থাকলেও ওই হাত দিয়ে কেড়ে নিত। কনকনে শীতের সময় কোনো কাপড় নিত না। মাটির মধ্যে শুয়ে থাকত। ওর বাবা তো অচল, মা কোনো রকমে টিকে আছে। নিজেদের খাবার জুটে না ঠিকমতো। দ্রুত আনোয়ারের যাতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় এই দাবি জানাই আমি।
এ ব্যাপারে ডিমলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। তবে এখন খোঁজখবর নিয়ে কী করা যায়, সেটি দেখব।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নূরুন নাহার নূরী বলেন, ছেলেটি প্রতিবন্ধী এবং তার বাবা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে। অত্যন্ত অমানবিক একটি ঘটনা ঘরে শেকলে বাঁধার বিষয়টি। বলা যায় হৃদয়ে আঘাত করেছে।
তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং কী করা যায়—সেটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।