যেভাবে পরকীয়ার বলি দুই শিশু, চার জনের বিরুদ্ধে মামলা
টানা সাত মাসের পরকীয়া প্রেম। দফায় দফায় শারীরিক সম্পর্ক। ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ। ইচ্ছে সংসার করার। পরকীয়া প্রেমিক শিশুদের নিয়ে বিয়ে করতে রাজি নয়। পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় দুই শিশু। তাই যে কোনো ভাবেই হোক, তাদেরকে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে। এমন পরিকল্পনা থেকেই নিষ্পাপ দুই সন্তানকে মিষ্টির সাথে বিষ খাইয়ে গর্ভধারিণী মা হত্যা করে। ঘটনাটি ভিন্ন দিকে মোড় ঘুরাতে সাজানো হয় নাপা সিরাপ সেবনে মৃত্যুর কথা। এ নিয়ে তোলপাড় হয় সারা দেশ। ঘটনা তদন্তে পৃথক চারটি কমিটি গঠন করা হয়। টনক নড়ে স্বাস্থ্য বিভাগেরও। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্রিফিং করেন সাংবাদিকদের। নড়েচরে বসে স্থানীয় প্রশাসন।
গত ১০ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের দুর্গাপুর গ্রামে নাপা সিরাপ সেবনের কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দুই সহোদর শিশু ইয়াছিন খান (৭) ও মোরসালিন খান (৫)। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয় নাপা সিরাপের। সেখানে ক্ষতিকর উপাদান মেলেনি। এর মধ্যেই জেলা পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
পুলিশ সূত্র জানায়, এক সপ্তাহ ধরে নজরবন্দি রাখা হয় শিশুদের মাকে। প্রযুক্তিগত তদন্তসহ নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে চাঞ্চল্যকর এই ডাবল মার্ডার রহস্য ৭ দিনের মধ্যেই উদঘাটন করে পুলিশ।
বুধবার রাতে আশুগঞ্জ থানা পুলিশ শিশুদের মা লিমা আক্তারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতে জবানবন্দির পর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লিমা আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পুলিশের কাছে এর আদ্যপান্ত বর্ণনা দেয়। পরকীয়া প্রেমিক সফিউল্লাহকে গ্রেপ্তারেও পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযানে চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, শিশুদের মা লিমা আক্তার মইসার গ্রামে শ্রমিক সর্দার সফিউল্লাহর সাথে দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। এরপর তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে শিশু দুটি তাদের নতুন সংসার করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই পথের কাঁটা সরাতে এই নৃশংসতার পথ বেছে নেয় তারা। পূর্বকল্পিতভাবে পরকীয়া প্রেমিক তাঁর বাড়িতে বিষ মেশানো ৫টি মিষ্টি পাঠায়। মিষ্টিগুলোর মধ্যে বড় শিশুকে তিনটি ও ছোট শিশুকে দুটি খাওয়ানো হয়। এর পর তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর আগ থেকেই তাদের কিছুটা জ্বর ছিল। তাই লিমার মাকে ওষুদের দোকান থেকে নাপা সিরাপ আনতে বলে। পরে সিরাপও খাওয়ানো হয়।
যেভাবে হত্যা করা হয় শিশু সন্তানদের
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১২ বছর আগে লিমার বাবা-মা তার অমতে পাশের পাড়ার ইসমাইল হোসেন সুজনের সঙ্গে বিয়ে দেয়। বিয়ের আগে সে ইসমাইল হোসেনকে কখনো দেখেনি। বিয়ের দিন সে জানতে পারে তার স্বামী চোখে দেখে না এবং স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারে না। বিয়ের প্রথমদিন থেকেই স্বামীকে তার পছন্দ ছিল না। বিয়ের ১৫ দিন পর স্বামী তাকে বাপের বাড়ি থেকে আনতে গেলে সে তাঁর সঙ্গে গিয়ে সংসার করতে রাজি ছিল না। এরপর তাঁর চাচাতো ভাই জমিন ও মা সবাই বোঝালে অনিচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও স্বামীর বাড়িতে এসে সংসার করতে থাকে। স্বামী স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারে না বলে, বিয়ের এক বছর পর থেকেই সে ধানের মিলে কাজ শুরু করে। পরে নিজেই উপার্জন করে সংসার চালাতে থাকে। বিয়ের দুই বছর পরে তার প্রথম ছেলে সন্তান হয়। অসুখের কারণে জন্মের দুই দিন পরই হাসপাতালে সে মারা যায়। এই ঘটনায় সংসারের ওপর থেকে তার মন উঠে যায়। বিয়ের প্রায় ৪ বছর পরে তার দ্বিতীয় সন্তান ইয়াছিন জন্মগ্রহণ করে। এরপর থেকে ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে অভাব অনটন বেড়ে যায়। স্বামীর সঙ্গে তার অশান্তিও বাড়ে। সংসারে তার শাশুড়ি, ভাসুর ও ভাসুরের বউ বিয়ের পর থেকে বিভিন্নভাবে তাঁর স্বামীকে ভুল বুঝিয়ে লিমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার করত। এভাবেই সে রাইস মিলে কাজ করে সংসার চালাতো। ইয়াছিনের আড়াই বছর পরে তার তৃতীয় সন্তান মুরছালিন জন্মগ্রহণ করে। তখন সংসারের দায়িত্ব বেড়ে গেলে পারিবারিক অশান্তি আরও বেড়ে যায়। সে সময় লিমা দুই সন্তানকে বাসায় রেখে বাহাদুপুরে বাহাউদ্দিনের ধান মিলে কাজ শুরু করে। এই মিলে প্রায় ৭ বছর কাজ করে। ২০২০ সালে শুরুর দিকে বাহাদুরপুর লাল ফারুকের ধানের মিলে কাজ শুরু করে। সেখানে এক বছর কাজ করার পর প্রায় ১০ মাস আগে বগইর এলাকায় এস আলম রাইস মিলে কাজ শুরু করে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এস আলম রাইস মিলে কাজ করতে গিয়ে দুই মাস পরে মিলের সর্দার সফিউল্লাহ ওরফে সোফাই এর সাথে পরিচয় হয়। কিস্তির দশ হাজার টাকা ধারের জন্য সোফাই সর্দার এর কাছে গেলে তাঁর কুনজর পড়ে। এভাবে ৩ মাস পরে তার সাথেই কাজ করা একজনকে দিয়ে সোফাই সর্দার বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সে সময় স্বামী ও দুই সন্তানের কথা বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁর স্বামীর শারীরিক অক্ষমতা ও সংসারের অভাব অনটনের কারণে সর্দার এর উপর লিমার আকর্ষণ বাড়তে থাকে। স্বামী ইট ভাটার কাজে সিলেটে গেলে সোফাই সর্দারের সাথে তার অবাধ মেলামেশার সুযোগ তৈরি হয়। প্রায় তিন মাস আগে এভাবে চলতে চলতে দুজনের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে ফেনে কথোপকথন এবং ধানের মিলে দেখা সাক্ষাত চলছিল। স্বামীর দেওয়া মোবাইল ও সিম ব্যবহার করে তারা কথা বলতো। গত এক মাস আগে সোফাই সর্দার তার সিমটি লিমাকে ব্যবহার করতে দেয়। মাঝে মাঝেই সোফাই সর্দার দুই ছেলেকে ছেড়ে লিমাকে বিয়ের কথা বলত। সন্তানদের কথা বললে সে বলত, পথের কাঁটা দুটা সরাও। ব্যবস্থা আমি করব। তোমার এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে না। ঘটনার তিন দিন আগে ৭ মার্চ সন্ধ্যায় দুজন এস আলম মিলে কাজের সময় বসে লিমার দুই সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে সময় সোফাই বলে, আমি বিষ মেশানো মিষ্টি তোমার বাড়িতে দিয়ে এলে তুমি সুযোগ বুঝে ছেলেদের তা খাওয়াইয়া দিবা। তারপর যা হবার হবে। ঘটনার দিন ১০ মার্চ তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েকবার কথা হয়। সে দিন আছর নামাজের পর লিমার শাশুড়ি এলাকায় ওয়াজ শুনতে বাড়ির বাইরে গেলে সেই সুযোগে সোফাই সর্দার বাড়ির পিছনের দক্ষিণ পাশের কোনায় এসে তার হাতে পলিথিনের ব্যাগে ৫টি মিষ্টি দিয়ে যায়। রাস্তায় গিয়ে লিমার শাশুড়িকে পাওনা টাকা দেওয়ার জন্য ফোন করে ডাকে। শাশুড়ি টাকা নিয়ে বাড়িতে এলে লিমার ছেলের গায়ে জ্বরের কথা বলে বুদ্ধি করে তাকে নাপা সিরাপ আনতে বাড়ির পাশের ফার্মেসিতে পাঠায়। এরপর পরিকল্পনা মাফিক বিষ মেশানো মিষ্টি দুই সন্তানকে খাওয়ায়। মিষ্টি খাওয়ানোর ৫ মিনিটের মধ্যেই নাপা সিরাপ নিয়ে তার শাশুড়ি এলে আধা চামচ করে দুই ছেলেকে খাওয়ানো হয়। সব কিছুই ছিল পরিকল্পনা মাফিক। যেন কেউ বুঝতে না পারে। সবাই যেন মনে করে ওষুধে কোন ঝামেলা ছিল, যার কারণে ছেলেরা মারা গেছে। ওষুধ খাওয়ার ১০ মিনিট পরে তাঁর দুই ছেলে একত্রে দুই বার বমি করে। তারপর তাদের মাথায় পানি ঢালা হয়। এরপর কাউছার মিয়ার সিএনজিতে দুই সন্তানকে নিয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার এসে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মূল বিষয় আড়াল করে বলা হয়, নাপা সিরাপ খাওয়ার পরে তার ছেলেরা বমি করে অসুস্থ হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে ডাক্তার বড় ছেলে ইয়াছিনকে ১৫ মিনিট এবং ছোলে মুরছালিনকে ১৫ মিনিট করে অক্সিজেন দেয়। আশুগঞ্জ হাসপাতালে এলে সোফাই সর্দার সেখানে তাদের দেখতে আসে। এরপর ডাক্তার দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে নিতে বললে সাদ্দামের সিএনজি করে তাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে টিকিট কেটে জরুরি বিভাগে দেখালে, ডাক্তার নাপা সিরাপ খেয়ে অসুস্থ হওয়ার কথা শুনে বাসায় গিয়ে বেশি বেশি লেবুর পানি খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। পরে সেখান থেকে সিএনজি করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে বিশ্বরোড মোড়ে আসতেই ছোট ছেলে মুরছালিন পানি খায় এবং আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে নিস্তেজ হয়ে যায়। এরপর খবর পেয়ে বাড়িতে পুলিশ এবং আশপাশের লোকজন জড়ো হলে বিষের কথা গোপন করে তাদেরকে জানানো হয়, নাপা সিরাপ খাওয়ার পরে তারা অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ঐদিন পুলিশ লিমার মোবাইল ফোনের নম্বর নিয়ে গেলে লিমা ভয় পায়। ১২ মার্চ লিমার সাথে একই মিলে কাজ করা মালার মাধ্যমে মোবাইল ফোন এবং সিমটি সোফাই সর্দারের কাছে ফেরত পাঠায়। এরপর তার স্বামী মোবাইল ফোনটি দেখতে না পেয়ে এই বিষয় নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করলে শাশুড়ি ও তাঁর মধ্যে ঝগড়া হয়। পরে বাড়িতে পুলিশের জেরার মুখে লিমা সব পরিকল্পনা ও অপরাধের কথা স্বীকার করলে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে থানায় ৪ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। তার মধ্যে দুই জন অজ্ঞাতনামা।
শিশু দুটির বাবা ইসমাইল জানান, লিমাকে সফিউল্লাহ সর্দারের দেওয়া সিমকার্ড ঘিরে সন্দেহ থেকেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও সে হত্যার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। আমি এর বিচার চাই।
এদিকে পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে হত্যার কথা জানিয়ে বলেন, রহস্যে ঘেরা ঘটনাটি প্রযুক্তিগত সহায়তা ও স্থানীয় তদন্তের মাধ্যমে উন্মোচন করা হয়।