আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার ৬ দিন পরই শাহজালালে অগ্নিকাণ্ড

রাজধানীর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর কার্গো নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার ছয়দিন পরই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বিমানবন্দরটির কার্গো ভিলেজে শনিবার (১৮ অক্টোবর) আগুন লেগে ছাই হয়ে গেছে আমদানি করা বিপুল মালামাল। এতে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
গত ১২ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্টের (ডিএফটি) নিরাপত্তা মূল্যায়নে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (এইচএসআইএ) ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (ওআইএ) উভয়ই অসাধারণ রেটিং অর্জন করে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্টে সম্পন্ন ওই মূল্যায়নে ডিএফটি শাহজালাল বিমানবন্দরকে সামগ্রিকভাবে ৯৩ শতাংশ নম্বর দিয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত ব্যবস্থা মূল্যায়ন (কার্গো) বিভাগ পেয়েছে শতভাগ, অর্থাৎ ১০০ শতাংশ।
ওসমানী বিমানবন্দরও ৯৪ শতাংশ সামগ্রিক স্কোর এবং কার্গো ব্যবস্থাপনায় ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে।
ডিএফটির এই বিদেশি বিমানবন্দর মূল্যায়ন কর্মসূচি মূলত যুক্তরাজ্যে যাত্রী ও কার্গো পরিবহণকারী বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা মান যাচাইয়ের জন্য পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, এই ফলাফল বাংলাদেশের বিমান নিরাপত্তা অগ্রযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের সামঞ্জস্যের প্রতীক। এই অর্জন আমাদের বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৃঢ়তা ও দক্ষতার প্রতিফলন, যার সরাসরি প্রভাব রয়েছে জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ওপর।
২০১৬ সালে কার্গো স্ক্রিনিং-সংক্রান্ত ত্রুটির কারণে ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে সরাসরি পণ্য পরিবহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। ফলে রপ্তানিকারকদের তৃতীয় দেশে পুনরায় পণ্য স্ক্রিনিং করতে হতো, যা ছিল ব্যয়বহুল ও জটিল প্রক্রিয়া। এরপর থেকে সিএএবি ও সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অবকাঠামো, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। কার্গো নিরাপত্তায় যুক্ত করা হয় আধুনিক বিস্ফোরক শনাক্তকরণ সিস্টেম (ইডিএস) ও বিস্ফোরক শনাক্তকরণ কুকুর (ইডিডি)।
তবে স্বীকৃতি পাওয়ার মাত্র ছয় দিন পর ১৮ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে নজিরবিহীন অগ্নিকাণ্ডকে নাশকতা হিসেবে আশঙ্কা করেছে বিভিন্ন মহল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এ ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি নাশকতার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।
প্রায় ২৭ ঘণ্টা চেষ্টার পর বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে লাগা আগুন সম্পূর্ণ নেভানো সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
এদিকে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে পোশাক তৈরির মূল্যবান কাঁচামাল, রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা পোশাক ও গুরুত্বপূর্ণ নমুনা পণ্য বা স্যাম্পল ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান।
ইনামুল হক খান আরও বলেন, এই ঘটনায় আমরা বিজিএমইএ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই দুর্ঘটনায় দেশের রপ্তানি বাণিজ্য, বিশেষ করে পোশাক শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য আজ আমরা এখানে এসেছি। সাধারণত হাই ভ্যালুড পণ্য ও জরুরি শিপমেন্টের ক্ষেত্রে আকাশপথে জাহাজীকরণ করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ফলে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পণ্যসামগ্রী পুড়ে এখন ছাই।
এদিকে, শাহজালাল বিমানবন্দরের পুড়ে যাওয়া কার্গো ভিলেজ পুনরায় সচল করতে ১৫ থেকে ৩০ দিন লাগবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক ফয়সাল সামাদ।
আজ রোববার শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে ফয়সাল সামাদ বলেন, আমরা ভেতরে গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি। আগুনে পুরো আমদানি সেকশন পুড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে নতুন পণ্যের আমদানি কার্যক্রমে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। আপাতত টার্মিনাল-৩ এ নতুন স্থানে আমদানি পণ্য রাখার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা। এছাড়া ৭২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আমাদানি পণ্য দ্রুত খালাস করার নির্দেশনা দিয়েছেন উপদেষ্টা। কাস্টমসের সঙ্গে যৌথভাবে একটি ওয়ার্কিং কমিটি করা হচ্ছে, যাতে দ্রুত মালামাল খালাস করা যায়। এমনকি শুক্র-শনিবারও কাজ চলবে।
পোশাক শিল্পের বিপুল ক্ষতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের কাছে বেশকিছু বিষয়ে জোরালোভাবে অনুরোধ করেছে বিজিএমইএ। এগুলো হলো—এই অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, সে বিষয়ে দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করা। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য সার্বিক সহযোগিতা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। পোশাক শিল্পের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার স্বার্থে বন্দরের বর্তমান পরিস্থিতি নির্বিশেষে যেন অন্যান্য নিয়মিত শিপমেন্টগুলোও স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে, তার জন্য সকল প্রক্রিয়াকে সহজ ও দ্রুততর করা। রপ্তানি পণ্য খোলা জায়গায় না রেখে বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর এলাকায় পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি না হয়। বিজিএমইএ ঢাকার বিমান বন্দরে পোশাক শিল্পের আমদানিকৃত মালামাল ৩৬ ঘন্টার মধ্যে খালাস করার জন্য সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছে।