হলে ছাত্রদের আটকে ছাত্রলীগের নির্যাতন, উদ্ধার করেনি প্রশাসন পুলিশ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় (বেরোবি) ১৯তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। সাক্ষী শান এ রওনক বসুনিয়া বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রকে ছাত্রলীগের ছেলেরা হলে আটকে রেখেছে এবং তাদের উদ্ধারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ কোন চেষ্টা করেনি। যার কারণে শিক্ষার্থীরা আটকে থাকা ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য ১ নং গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করে।
আজ মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। অপর সদস্যরা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
আবু সাঈদ হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ছয় আসামি কারাগারে রয়েছেন। তাঁরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান, সাবেক কর্মচারী আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ। গতকাল তাঁদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
১৯তম সাক্ষী শান এ রওনক বসুনিয়া তার জবানবন্দিতে বলেন, আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ২৬ বছর। আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আনুমানিক ১.৪৫টার দিকে আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান করার জন্য বাড়ি থেকে বের হই। আমার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য বেরোবির ১ নং গেটের অপরদিকে যে কাঠের ব্রিজ আছে সেটা পার হয়ে আনুমানিক দুপুর ২টার দিকে ০১ নং গেটের সামনে পৌছাই। সেখানে গিয়ে আমি দেখি যে, ০১ নং গেটের সামনে অনেক ছাত্রছাত্রী একত্রিত হয়েছে। সেখানে গিয়ে আমি জানতে পারি যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রকে ছাত্রলীগের ছেলেরা হলে আটকে রেখেছে এবং তাদের উদ্ধারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ কোন চেষ্টা করেনি। যার কারণে শিক্ষার্থীরা আটকে থাকা ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য ১ নং গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু তখন ০১ নং গেটটি বন্ধ ছিল এবং গেটের সামনে পুলিশ দাড়িয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছিল।
এক সময় পুলিশ গুলি চালায় এবং লাঠিচার্জ করা শুরু করে এবং তখন আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তখন আমি ০১ নং গেটের বিপরীতে কাঠের ব্রিজের দিকে চলে আসি এবং সেখান থেকে আমি দেখতে পাই যে, কয়েকজন পুলিশ একজন কালো টিশার্ট পড়া আন্দোলনকারী ছাত্রকে মারধর করছে। আমি কিছুক্ষণ পর আবার ০১ নং গেটের দিকে যাই। ছত্রভঙ্গ হওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা তখন আবার ০১ নং গেটের সামনে জমায়েত হতে থাকে। তখন পুলিশ ০১ নং গেটের ভিতরে ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থান করছিল। তখন আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা ০১ নং গেট ধাক্কাধাক্কি করে খুলে ফেলে।
সে সময় আমি দেখতে পাই যে, পুলিশের সাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান, আসাদ মন্ডল ও নুরুন্নবী, নূর আলম, আমির হোসেন, মাহবুব, আপেলসহ আরো কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী ও বেরোবি ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সহসভাপতি শামীম মাহফুজ, টগর, বাবুল, গ্লোরিয়াস রাব্বী, এমরান চৌধুরী, মাসুদসহ আরো কিছু বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আমাদের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। তখনই পুলিশ গুলি করতে করতে ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে ১ নং গেট দিয়ে আন্দোলনকারীদের দিকে আসতে থাকে।
এর মধ্যে ছত্রভঙ্গ কিছু ছাত্রছাত্রী কুড়িগ্রাম সড়কের দিকে যায়, কেউ লালবাগের দিকে যায়, কেউ সরদারপাড়ার দিকে যায়। কিছু কিছু শিক্ষার্থী কাঠের ব্রিজ দিয়ে সরদার পাড়ার দিকে যায়। তখন আমি বিয়াম মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখান থেকে আমি দেখি যে, একজন আন্দোলনকারী ছাত্র পুলিশের সামনে দুহাত মেলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই পুলিশ কয়েকবার গুলি চালায়।
আমি দেখি যে, সেখানে দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে বসে পড়ে। তখন একজন আন্দোলনকারী ঐ ছাত্রকে ধরে দাঁড় করায় এবং নিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন গুলিবিদ্ধ ছাত্রটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন আমিসহ আরো কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে গুলিবিদ্ধ ছাত্রটিকে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এরমধ্যে পুলিশের ছোড়া গুলি আমার কোমড়ের বাম পাশে এবং বাম পায়ের হাঁটুর নিচে লাগে।
তখন আরো কিছু ছাত্রছাত্রী এগিয়ে আসে এবং গুলিবিদ্ধ ছাত্রটিকে পার্কের মোড়ে নিয়ে গিয়ে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আনুমানিক বিকেল ৩.৩০ এর সময় আমি জানতে পারি যে, সেই গুলিবিদ্ধ ছাত্রটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় এবং তার নাম আবু সাঈদ।
আমি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও কোথাও চিকিৎসা নিতে যাই নাই। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ১ নং গেটের সিসিটিভির বিভিন্ন ফুটেজ দেখে জানতে পারি যে, কোতোয়ালি জোনের এসি আরিফুজ্জামান, তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম এবং বেরোবি পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বিভূতিভূষণ রায় এর নির্দেশে এএসআই আমির হোসেন এবং কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় আবু সাঈদকে গুলি করে।
এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. হাসিবুর রশিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা রয়েছে। আমি একজন ছাত্র ও সচেতন নাগরিক হিসাবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং এরূপ সকল হত্যাকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনার সাথে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের সবার বিচার চাই। ২৬/০২/২০২৫ ইং তারিখে তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ইহা আমার জবানবন্দি।
গ্রেপ্তারকৃত ছয় আসামি হলেন, এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ।
গত ২৭ আগস্ট সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত ৬ আগস্ট ৩০ আসামির বিরুদ্ধে ফর্মাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসিসহ ২৪ জন এখনও পলাতক রয়েছেন। তাদের পক্ষে গত ২২ জুলাই সরকারি খরচে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।
গত ৬ অক্টোবর নবম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। ওই দিন জবানবন্দি দেন পুলিশের দুই উপপরিদর্শক। তারা হলেন, এসআই রফিক ও এসআই রায়হানুল রাজ দুলাল। দুজনই জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। পরে তাদের জেরা করেন পলাতক ২৪ আসামির পক্ষে চার স্টেট ডিফেন্সসহ গ্রেপ্তারদের আইনজীবীরা।
এর আগে, ২৯ সেপ্টেম্বর অষ্টম দিনের মতো সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়। ওই দিন জবানবন্দি দিয়েছেন তিনজন। ২২ সেপ্টেম্বর সপ্তম দিনে প্রথমে ছয় নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া সিয়াম আহসান আয়ানকে জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ২১ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য দেন আয়ান। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তিনিই আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিতে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন। নিজের সাক্ষ্যতেও পুরো বর্ণনা তুলে ধরেছেন এই সাক্ষী।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর পঞ্চম দিনের মতো জেরা শেষ হয়। ওই দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরিয়ান আনিসুর রহমানকে জেরা করা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর চতুর্থ দিনে পাঁচ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। একই দিন এসআই মো. তরিকুল ইসলামও জবানবন্দি দেন।
৮ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলামের জেরা শেষ করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ৭ সেপ্টেম্বর তিনি জবানবন্দি দেন। ওই দিন দ্বিতীয় সাক্ষী রংপুরে কর্মরত এনটিভির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট একেএম মঈনুল হককেও জেরা করা হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক